স্টাফ রিপোর্ট:
কুলাউড়ায় নানা প্রতিবন্ধকতা সত্তে¡ও ইচ্ছা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে সফলতা অর্জন করেছেন প্রত্যন্ত অঞ্চলের নি¤œ মধ্যবিত্ত পরিবারের তিন নারী। এরা হলেন- রোমেনা আক্তার, স্বর্ণালী বিশ্বাস ও অনিতা রানী মালাকার।
অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী রোমেনা আক্তারের বাবা ছিলেন জনতা ব্যাংকের ৪র্থ শ্রেনীর কর্মচারী। ৫ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। এইচএসসি পাশের পর অল্প বয়সে বাবা তাকে বিয়ে দিয়ে দেন। বিয়ের পর জীবন স্বাভাবিকভাবে চলছিল। স্বামী একটি প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকরি করতেন। পরে চাকরি ছেড়ে দিয়ে একটি স্টেশনারী দোকান দেন। ব্যবসায় সুবিধা করতে না পারায় সংসারে আর্থিক সংকট দেখা দিল। তখন রোমেনা আক্তার একটি প্রতিষ্ঠান থেকে সেলাই, ব্লক-বাটিক, বুটিক, এমব্রোয়ডারি কাজের প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ লব্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে তিনি প্রথম দিকে খুব ছোট আকারে ব্যবসা শুরু করেন। তিনি মেয়েদের জন্য হেয়ার ব্যান্ড তৈরী করা শুরু করেন। ধীরে ধীরে তার ব্যাবসার প্রসার ঘটাতে থাকেন। কুলাউড়া বাস স্ট্যান্ডের নিকটে তার একটি শোরুম রয়েছে, যেখানে তার উৎপাদিত পণ্য সামগ্রী বিক্রয় করেন। তার কারখানায় অসচ্ছল মেয়েদের কর্ম-সংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। ছাত্রিরা এখানে কাজ করে উপর্জিত অর্থ দিয়ে তাদের পড়ালেখার খরচ চালিয়ে নিতে পারছে। তিনি ব্যবসার পাশাপাশি জনকল্যান মূলক কাজও করে যাচ্ছেন।
শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী স্বর্ণালী বিশ্বাস কুলাউড়ার প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা ছিলেন দরিদ্র কৃষক ও মা গৃহীনি। পিতার সামান্য রোজগারে কোনমতে সংসার চলতো। ৪ বোনের সবার বড় সন্তান স্বর্ণালী। আর্থিক টানাপোড়েন ও শত বাঁধা বিপত্তি স্বত্তেও তিনি নিজের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় লেখাপড়া চালিয়ে যান। বর্তমানে তিনি একটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষক পদে কর্মরত। এই শিক্ষক হওয়ার পিছনে রয়েছে তার কঠোর পরিশ্রম, দৃঢ় মনোবল আর মা বাবার সর্বঙ্গীন প্রচেষ্টা। গরিব ও দরিদ্রতায় পরিপূর্ণ ছিল তাদের সংসার। ছোটবেলা থেকেই তিনি সবসময় পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। গাইড বই কিনার মত সামর্থ তার বাবার ছিল না। মাঝে মধ্যে অন্যের গাইড বই ধার করে এনে পড়তেন। খাতা কলম ক্রয়ে তার মা হাঁস মুরগীর ডিম বিক্রয় করে টাকা দিতেন। পরিবারে শিক্ষিত কোন লোক না থাকায় তাকে পড়াশুনা রপ্ত করতে ভিষণ কষ্ট করতে হয়েছে। তিনি বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশুনা করেছেন। বিজ্ঞানের কঠিন বিষয়গুলো নিজে নিজে অধ্যাবসায় করেছেন। এস.এস.সি. পরীক্ষার ফরম ফিলাপ করার টাকা না থাকায় স্কুলের সকল শিক্ষকবৃন্দ আর্থিকভাবে তাকে সহায়তা করেন। ক্যালকুলেটর না থাকায় গনিতের সমাধান করতে তাকে হিমশিম খেতে হত। গ্রামের একজন শিক্ষক তাকে একটি ক্যালকুলেটর ক্রয় করে দেন। ধান বিক্রি করে তার বাবা তাকে কলেজে ভর্তি করান। টাকার অভাবে নিয়মিত কলেজে যেতে পারতেন না। তিনি নিজে পড়াশুনার পাশাপাশি গ্রামের ছোট ছোট বাচ্চাদের টিউশনি পড়াতেন। মা হাঁস মুরগীর ডিম বিক্রি করে আর স্বর্ণালী টিউশনির টাকায় কিস্তির টাকা পরিশোধ করা হতো। তার বাবা কৃষি কাজ করে ভাতের যোগান দিতেন। এতো অভাব অনটনের মধ্যে থেকেও তার মা-বাবা তাকে পড়াশুনা বন্ধ করতে বলেন নাই। তিনি নিজেও হাল ছাড়েন নাই। এভাবেই তিনি মাস্টার্স পর্যন্ত পড়ালেখা সম্পন্ন করলেন। এরপর তিনি চাকরির জন্য কিস্তিরি টাকা তুলে ঢাকা যেয়ে হাইস্কুলে চাকরির ভাইবা দিলেন ও একটি এমপিও ভূক্ত হাইস্কুলে চাকরি পেলেন। এর কিছুদিন পর তিনি কুলাউড়ায় একটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষক পদে চাকরী পান। স্বর্ণালীর জীবনের এই সফলতা অত্যন্ত গর্বের। তার জীবন সংগ্রাম, পথ চলা, শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সাফল্য নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের জন্য অনুকরনীয় এবং অনুস্মরনীয় দৃষ্টান্ত।
কুলাউড়ার সফল জননী অনিতা রানী মালাকারের জন্ম পৃথিমপাশা ইউনিয়নের আলীনগর গ্রামে। ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। অল্প বয়সে বিয়ে হয় য়ায়। সংসার জীবনে এসে শুরু হয় তার টিকে থাকার লড়াই। রিক্সাচালক স্বামীর আয় রোজগারই সংসার চলতো। ২য় সন্তান জন্মের পর তিনি একটি এনজিও সংস্থায় (জাতীয় পুষ্টি কার্যক্রম) সামান্য বেতনে কাজ নেন। ১০ বছর কাজ করার পর এনজিওটি বন্ধ হয়ে যায়। এর পর সংসারের হাল ধরতে তিনি হাঁস মুরগী ও ছাগল পালন শুরু করেন। এখান থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়ে তিনি তার সন্তানদের পড়াশুনার খরচ মেটাতেন। তার এক ছেলে তিন মেয়ে। ২০২৩ সালে তার বড় দুই ছেলে মেয়ে একত্রে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে চাকরী পায়। ২০২৪ সালে ছেলে শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে অগ্রনী ব্যাংকে ক্যাশ অফিসার পদে চাকরীতে যোগদান করেন। ২য় মেয়ে মুরারীচাঁদ কলেজে ইংরেজী অনার্স ১ম বর্ষে অধ্যয়ন করছে। কনিষ্ঠ কন্যা লংলা আধুনিক ডিগ্রী কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ১ম বর্ষে অধ্যয়নরত। কঠিন পরিস্থিতিতেও অনিতা রানী মালাকার তার সন্তানদের মানুষ করার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
caller_get_posts is deprecated. Use ignore_sticky_posts instead. in /home/eibela12/public_html/wp-includes/functions.php on line 6121caller_get_posts is deprecated. Use ignore_sticky_posts instead. in /home/eibela12/public_html/wp-includes/functions.php on line 6121
Leave a Reply