আলী হামিদ খান ::
বাঙ্গালির চা প্রীতি আর চায়ের আড্ডা নিঃসন্দেহে সমসাময়িক বাঙালি সংস্কৃতির এক অবিছেদ্দ অংশ। বাস্তবে হোক বা সাহিত্যে, শীতে কিংবা বর্ষায়, সকালে সন্ধ্যায়, সভা সমাবেশে, আনন্দে-আপ্যায়নে, ঘরে-বাহিরে, হাটবাজারে, গ্রাামে শহরে, ছেলে বুড়ো, নারী পুরুষ, সকলেরই চাই ধোঁয়া ওঠা গরম গরম চা। চা ছাড়া বাঙ্গালীর জীবন অকল্পনীয়, চা যেন এক জাগ্রত জীবনীশক্তির আধার। রাস্তার পাশের চায়ের দোকানগুলোর বেঞ্চিতে বসে থাকা নানান বয়সী মানুষ আর তাদের হাতে উষ্ণ ধোয়া ওঠা চায়ের কাপ এখন বাংলাদেশের সর্ব প্রান্তের একটি সার্বজনীন দৃশ্য।
চা শুধু যুগে যুগে বাঙ্গালীর দেহ আর মনকেই সতেজ করেনি, সাথে সাথে বাংলাদেশের অর্থনীতিও সচল রেখেছে। এদেশের চা চাষের ইতিহাস বহু বছর পুরনো আর গৌরবময় । মূলত সিলেট ও এর আশেপাশের অঞ্চল ঘিরেই আমাদের দেশের চা বাগান। উঁচু নিচু টিলা আর পাহাড়ি জমিতে যতদূর চোখ যায়, বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে রয়েছে চিরহরিৎ চা গাছ; আর তার ফাঁকে ফাঁকে দাঁড়িয়ে থাকা উঁচু উঁচু শীতল ছায়াদানকারী বৃক্ষ। বাগানজুরে প্রজাপতির মত ঝুড়ি কাঁধে ঘুরে বেড়ানো শ্রমিকেরা তাদের হাতের বিশেষ দক্ষতায় অনবরত বেছে নিচ্ছে চায়ের নতুন পাতা ও এর কুড়ি। আর সংগ্রহের পর পাতাগুলি কারখানায় প্রক্রিয়াজাত করে কালো চা গুড়ো তৈরি করা হয় বাজারজাত করনের জন্য। [আর এই গুড়ো চা-ই ফুটন্ত পানির সাথে মিলিয়ে প্রস্তুত হয় পছন্দের নানান পদের চা, দুধ চা থেকে শুরু করে লাল চা, আদা চা, মাশালা চা, লেবু চা, পুদিনা চা, মালটা চা, সাত রঙ চা, কি নেই বাঙ্গালীর বৈচিত্র্যময় স্বাদের এই চায়ের রাজ্যে!]
[শুধুমাত্র চা পান করেই নয়, চা দেখেও মন জুরায়। চোখ জুড়ানো সবুজ গালিচার মত চায়ের বাগান গুলোতে ভ্রমন মৌসুমে পর্যটকদের ভীর লেগে থাকে।] দেশে ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ১৬৮ টি চায়ের বাগান রয়েছে এবং এর মধ্যে শুধুমাত্র মৌলভীবাজার জেলাতেই রয়েছে সর্বোচ্চ ৯১ টি বাগান; এই জেলাতে চা বাগানের আধিক্যের কারনে শ্রীমঙ্গলকে বাংলাদেশের চায়ের রাজধানী বলা হয়। সিলেট বিভাগের বাকি অঞ্চলে, হবিগঞ্জে এবং সিলেট জেলায় যথাক্রমে ২৫ টি এবং ১৯ টি করে চা বাগান রয়েছে। এছাড়া, আমাদের উত্তর ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলিতেও প্রচুর চা চাষ হয়। পঞ্চগড় জেলায় ৮ টি, ঠাকুরগাঁওয়ে ১ টি, চট্টগ্রামে ২২ টি এবং রাঙ্গামাটিতে ২ টি চা বাগান দেশের চা উৎপাদন বিশেষ অবদান রাখছে।
[এই এক একটি চা বাগান গুলোর রয়েছে গৌরবময় অতিত, এমনকি এই বাগান গুলো আমাদের মুক্তি সংগ্রামে ইতিহাসের সাথেও ওতপ্রোত ভাবে মিশে আছে।] ব্রিটিশ ভারতের পূর্ব বাংলায়/বাংলাদেশের প্রথম চা বাগানটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৫৪ সালে, যার নাম মালিনীছরা, বাগানটি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বর্তমান সিলেটে শহরের পাশেই/। মূলত এই মালিনীছরার সাফল্যেই ব্রিটিশরা সিলেট অঞ্চলে বাপকভাবে চায়ের চাষ শুরু করে, এবং পরবর্তীতে এই অঞ্চলে একটি চা বাগান কেন্দ্রিক সাহেবি/ উপনিবেশিক সংস্কৃতি তৈরি হয়। চা বাগানের সাথে সম্পৃক্ত ব্রিটিশ সাহেব এবং তাঁদের পরিবারের থাকার জন্য বাগানগুলোতে তৈরি হতে থাকে বিরাট বিরাট বাংলো বাড়ি আর অবসরের বিনোদনের জন্য ক্লাব ঘর। ব্রিটিশদের পাশাপাশি দেশীয় অভিজাত, জমিদার এবং ধনী ব্যবসায়ীরাও লাভজনক চা চাষে উদ্যোগী হন এবং এইভাবেই কালক্রমে সিলেট অঞ্চলের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে চা চাষের এবং চা বাগানের প্রসার ঘটতে থাকে।
দেশীয় জমিদারদের মধ্যে অনেকেই প্রচুর টাকা লগ্নি করে চা চাষ শুরু করেন, তাঁদের মধ্যে নতুন চা বাগান প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি ও অগ্রগামীরা হলেন- সৈয়দ আবদুল মজিদ, নবাব আলী আমজাদ খান, মুহাম্মদ বখত মজুমদার, গোলাম রাব্বানী, সৈয়দ আলী আকবর খন্দকার, আবদুর রশীদ চৌধুরী এবং করিম বখশ। কালের পালাবদলে এই ঐতিহ্যবাহী পরিবারকেন্দ্রিক চা বাগানগুলো অধিকাংশই এখন দেশি বিদেশি বিভিন্ন বৃহৎ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গুলোর মালিকানায় পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমানেও নতুন অঞ্চলে চা চাষের বিস্তারে দেশীয় বিনিয়োগকারীরা অগ্রগামী। তাছাড়া, চা চাষে মহিলা উদ্যোগতারাও অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন, লালমনিরহাট অঞ্চলে একজন মহিলা উদ্যোগতা সম্প্রতি স্বল্পপরিসরে চা বাগান শুরু করে সাফল্য পেয়েছেন এবং সেখান থেকে উন্নত মানের চা প্রক্রিয়াজাত করা শুরু হয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের চা বাগানগুলোর মোট জমির পরিমান দাঁড়িয়েছে ১১৮৭৮১.৪১ হেক্টর (২৪৩৫১১ একর) , যার মধ্যে ৫৯০১৮ হেক্টর (১৪৫৭৭৪.৪৬ একর) জমিতে চা গাছ রোপণ করা রয়েছে। চা বাগান গুলোর মধ্যে পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর এবং বান্দরবানের বাগান গুলোতে চা চাষের পরিধি বাড়ছে। এক্ষেত্রে পঞ্চগড়ে চা চাষ বৃদ্ধির পরিমান উল্লেখযোগ্য। স্থানীও কর্মসংস্থানেও চা-শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে, চা বিপনন, পরিবহন, প্রক্রিয়াকরণ ছাড়াও চা উৎপাদন বিপুল পরিমান চা শ্রমিক সম্পৃক্ত। বর্তমানে, সারাদেশের চা বাগানগুলোতে ৩০০,০০০ বা তার বেশি কর্মী সরাসরি নিযুক্ত আছেন, যার মধ্যে প্রায় ৭৫% ই মহিলা। এই কর্মীদের অধিকাংশই ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতের দরিদ্রতম প্রদেশগুলো যেমন বিহার, উড়িষ্যা, উত্তরপ্রদেশ ইত্যাদি থেকে আসা উপজাতি শ্রমিকদের বংশধর।
চায়ের জনপ্রিয়তা এবং সামগ্রিক ভাবে চা পানের পরিমান বৃদ্ধির কারনে দেশে চায়ের চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিগত বছর গুলোতে বাংলাদেশে চায়ের উৎপাদন বাড়লেও তা দেশীয় চাহিদা মেটাতে পর্যাপ্ত নয়। যদিও চায়ের উৎপাদন ১৯৯৯ সালে ৬ কোটি কেজি থেকে লক্ষণীয় হারে বৃদ্ধি পেয়ে ২০০৯ সালে ৯.৬৬৯ কোটি কেজি হয়েছে, তবুও দেশীয় চাহিদা বৃদ্ধির কারনে আমরা এখন বিশ্বের অন্যতম প্রধান চা রপ্তানিকারক দেশ থেকে চা আমদানিকারক দেশে পরিনত হয়েছি।
অতিতে দেশীয় চা শিল্পে ছোট ছোট চা বাগান গুলো চা উৎপাদনে অগ্রণী ভুমিকা রেখে আসলেও বর্তমানে তারা জাতীয় উন্নয়নের মুল ধারায় যোগ দিতে পারছে না এবং ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে পড়ছে। উৎপাদন এবং মূল্য নিয়ন্ত্রণ পরিপন্থী পরিকল্পনা ও উদ্যোগ এছাড়াও যথাযথ কর্তৃপক্ষের বাজার পর্যবেক্ষণের অভাবে দেশীয় চা শিল্পের ভবিষ্যতকে ক্রমান্নয়ে বিপন্ন করছে। বিশেষত ছোট আকৃতির বাগান মালিক এবং চা উৎপাদন কারিরা প্রাকৃতিগত কারণ থেকে তুলনামূলক ভাবে মনুষ্যসৃষ্ট প্রতিবন্ধকতার কারণে অপেক্ষাকৃত বেশি সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে।
কার্যকরী বাজার নিয়ন্ত্রনের অভাবে ছোট ছোট চা বাগানগুলি প্রতিনিয়ত আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একই সাথে, কাচামাল পরিবহন এবং কাঁচামাল গুদামজাত করনের ব্যায় বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদন খরচ বহুলাংশে বৃদ্ধি ঘটেছে। তাছাড়া, ছোট চা বাগান গুলোর চা পাতা প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো না থাকায়, তারা তাঁদের উৎপাদিত কাঁচামাল দেশি বিদেশি প্রক্রিয়াজাতকারিদের কাছে তারা সর্বনিম্ন দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে ক্রমান্বয়ে আর্থিক সঙ্কটে পতিত ছোট ছোট চা বাগান মালিকদের পক্ষে বাগানগুলো পরিচালনার ব্যায়ভার বহন করা আর সম্ভব হছে না। বিগত বছরগুলোতে সিলেট অঞ্চলে বেশকিছু চা বাগান মালিক আর্থিক সংকট উত্তরণে প্রয়োজনীয় ঋণ সহায়তা না পাওয়ায় তাদের বাগান পরিচালনা বন্ধ অথবা বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। সর্বোপরি, করোনাকালীন পরিস্থিতিতে বাজারে চায়ের মূল্যহ্রাস সঙ্কটজনক হওয়ায় ছোট বাগানগুলোর পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছে। মালিকেরা তাদের দ্বিধাদ্বন্দ্বের সমাধান খুঁজে না পাওয়ায়, তাদের মধ্যে স্পষ্টতই একধরনের উদ্বেগ কাজ করছে।
চা বাগানগুলিতে এমন হতাশাজনক অবস্থাকে উপেক্ষা না করে, চা শিল্পের সঙ্কট উত্তরনের জন্য বেশ কিছু বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি/অবশ্যকরণীয়। এশিল্পকে পুনরায় একটি সমৃদ্ধশালী শিল্প হিসাবে গড়ে তোলার জন্য জরুরি ভিত্তিতে এর চলমান সমস্যা গুলোর সমাধান করা প্রয়োজন অন্যথায়, যথাযত কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা এই শিল্পের জন্য সামগ্রিক দুর্যোগ বয়ে আনতে পারে।
চা শিল্পের সঙ্কট উত্তরণে চা উৎপাদনের আধুনিকায়ন সর্বাধিক প্রাধান্য পেলেও/তালিকার শীর্ষে থাকলেও, নিয়মিত ঋণ সুবিধা নিশ্চিত করন সামগ্রিকভাবে এই শিল্পের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালণ করবে। ছোট ছোট চা বাগানগুলোর আর্থিক সহায়তা হিসাবে ঋণের ব্যবস্থা করা আবশ্যক। ছোট এবং অপেক্ষাকৃত স্বল্পপরিসরে উৎপাদনক্ষম বাগানগুলি যারা নিজস্ব প্রক্রিয়াজাতকরণ অবকাঠামো স্থাপন করতে অক্ষম, তাঁদের জন্য চা উপাদনকারী অঞ্চলগুলোতে কেন্দ্রীয় প্রক্রিয়াজাতকরণের কারখানা স্থাপন করতে হবে, যাতে বাগানগুলো তাদের কাচামাল স্বল্প খরচে প্রক্রিয়াজাত করতে যেতে পারে এবং তাঁদের উৎপাদনের গুনগত মান নিশ্চিত করতে পারে। বাগানে উৎপন্ন সবুজ পাতা দ্রুততম এবং স্বল্প খরচে গুদামজাত ও প্রক্রিয়াজাতকরণের কারখানায় পরিবহনের জন্য যথাযথ পরিবহন বাবস্থা চালু করা উচিত। পরিশেষে, বাগান মালিকেরা যাতে উথপাদিত পণ্য বিক্রিতে ক্ষতিগ্রস্ত না হন তার জন্য উৎপন্ন চায়ের নিলাম মূল্য পর্যবেক্ষণের করা উচিত।
চা শিল্পের উত্তরণের পথে সমসাময়িক সকল প্রতিবন্ধকতাকে অবশ্যই সদিচ্ছা, পেশাদারিত্ব এবং ব্যবসায়িক দক্ষতার সাথে মোকাবেলা করা প্রয়োজন। চলমান সমস্যা গুলো অবশ্যই নির্ভুলতা এবং বাস্তবিকতার সাথে পর্যবেক্ষণ করে, কার্যকরী সমাধান নিশ্চিত করতে পারলেই এই শিল্পের পর্যায়ক্রমিক বিকাশ এবং অগ্রগতি দৃশ্যমান হবে। চা চাষে সম্পৃক্ত সবাইকে অনুপ্রাণিত করে নিম্নমানের চা-পাতা উৎপাদন হ্রাস করনের মাধ্যমেই শুধুমাত্র বাংলাদেশর চা রফতানি গৌরবময় ঐতিহ্য পুনুরুদ্ধার করা সম্ভব। আর এই শিল্পের সাথে জরিত আমরা সকলেই আশাবাদী যে, যথাযথ কর্তৃপক্ষ শীঘ্রই কার্যকরী কিছু সমাধান নিয়ে আসবেন যা এই শিল্পের হারিয়ে যাওয়া সোনালি ইতিহাস ফিরিয়ে এনে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখবে।
[আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস আগামিতে চা শিল্পের পুনরুজ্জীবনের মাধ্যমে (মাননীয় প্রধান্মন্ত্রির) ২০৪১ সালের উন্নয়নশীল বাংলাদেশ বিনির্মাণে আগ্রযাত্রায় আমারা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করব।]#
লেখক : কলামিষ্ট ।
Leave a Reply