আব্দুল বাছিত বাচ্চু :: আজ ৬ই ডিসেম্বর। স্বৈরাচার পতন দিবস। ১৯৯০ সালের এই দিনে ছাত্রজনতার তীব্র গণ অভ্যুত্থানের মুখে স্বৈরাচার এরশাদের পতন হয়। সেনাপ্রধান হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদ আইনকানুনের তোয়াক্কা না করে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে হটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করেন। পরবর্তীতে প্রথমে গণভোট এবং পরে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন দিয়ে নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করেন। প্রতিষ্ঠা করেন জাতীয় পার্টি নামক রাজনৈতিক দল। শুরু করেন গরু কেনাবেচার মতো দল ভাঙার রাজনীতি। সিলেটের হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, নোয়াখালীর ব্যারিস্টার মওদুদ, চট্টগ্রামে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কাজী জাফর আহমেদ,চট্টগ্রামের সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, আনোয়ার জাহিদ, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন , কাজী ফিরোজ রশীদ,মেজর জেনারেল( অব:) মাহমুদুল হাসান সহ দেশের অনেক শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে পার্টিতে টানতে সক্ষম হন এরশাদ। এরপর দমন পীড়ন আর ভারতের সমর্থনে সামরিক কায়দার দেশ চালাতে থাকেন। রেডিও টেলিভিশনে নিজের আর স্ত্রী রওশন এরশাদের খবর এমনভাবে প্রচার শুরু করেন দেশের মানুষ বাংলাদেশ টেলিভিশনকে মিয়া বিবির বাক্স নামকরণ করে।
এমনি এক পরিস্থিতিতে গণতন্ত্রে ফেরার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ১৯৮৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করেন। আওয়ামী লীগ বিএনপি জামায়েত জাসদ কমিউনিস্ট পার্টি সহ দেশের রাজনৈতিক দল সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং এরশাদের পদত্যাগ ছাড়া কোনো নির্বাচনে যেতে অস্বীকৃতি জানান। ততকালীন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামে এক জনসভায় -এরশাদের অধীনে নির্বাচনে গেলে ‘জাতীয় বেঈমান ‘হিসেবে চিহ্নিত হবেন এমন ঘোষণা দিয়ে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন।
আমরা তখন ছাত্র। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের নেত্রীর এমন বক্তব্য শুনে আমরা নিশ্চিত হই দেশ স্বৈরাচারমুক্ত হবে। কিন্তু ২৪ ঘন্টার মধ্যে আশায় গুড়ে বালি। ঢাকায় ফিরে তিনি নির্বাচন অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেন। মুলতঃ ভারতের পরামর্শে বিএনপিকে নির্মুল করতে ছিলো তার এই সিদ্ধান্ত। জামায়াতে ইসলামী সহ আওয়ামী লীগের মিত্র দলগুলোও নির্বাচনে যায়।পরে মিডিয়া ক্যু করে এরশাদ ১৯৮ আসন কুক্ষিগত করতে সক্ষম হয়। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে এবং স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন অব্যাহত রাখে। মাত্র কয়েক মাসের মাথায় আওয়ামী লীগ ও জামায়েত আবারও এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেয়। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর ঢাকা অবরোধের ঘোষণা দেয় সকল রাজনৈতিক দল। পাশাপাশি পয়েলা নভেম্বর ছিলো জেলায় জেলায় অবরোধ। সিলেট কোর্ট পয়েন্ট ছিলো সিলেটে আন্দোলনের কেন্দ্র। পয়েলা নভেম্বর পুলিশ বিডিআর নজীরবিহীন দমন-পীড়ন চালায়। সেদিন কাঁদনে গ্যাসের ঝাঁঝে সিলেটের রাজপথে আমিও আহত হই।কয়েক বছর মাসে মাসে আমার দুই চোখ থেকে পানি ঝরেতো । তীব্র গণ আন্দোলনের মুখে পার্লামেন্ট বিলুপ্ত করে স্বৈরাচার এরশাদ দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে।
শুনেছি ততকালীন ডাকসুর ভিপি ও ছাত্রলীগের সভাপতি সুলতান মনসুরকে বড় এমাউন্টও দেয় এরশাদ। পরে ঘরোয়া রাজনীতি অত:পর ১৯৮৮ সালে অনুষ্ঠিত হয় একদলীয় নির্বাচন। আ স ম আব্দুর রবের জাসদ , কর্ণেল ফারুক -রশীদের ফ্রীডম পার্টি এবং কয়েকটি ইসলামি দল নিয়ে ওই নির্বাচনে একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করে জাতীয় পার্টি। বিরোধী দলের নেতা হন জাসদ সভাপতি আ স ম আব্দুর রব।
এভাবে কিছুদিন চলার পর ডাকসুর নির্বাচন দেয় এরশাদ শাহী। ভিপি পদে ঢাকার ছাত্রদল নেতা আমানউল্লাহ আমান, জিএস পদে নরসিংদীর খায়রুল কবির খোকন এবং এজিএস পদে ভোলার নাজিম উদ্দীন আলম বিজয়ী হন। এভাবে ডাকসু এবং বিভিন্ন হলে পূর্ণ প্যানেলে জয়লাভ করে ছাত্রদল। গঠিত হয় ছাত্রদল, ছাত্রলীগ ও বিভিন্ন বাম ছাত্রসংগঠন সমন্বয়ে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ৮ দল, বিএনপি নেতৃত্বে ৭ দল এবং সিপিবি জাসদ বাসদ সহ ৫ দল এবং জামায়াত আন্দোলন জোরদার করে। এমনি পরিস্থিতিতে তীব্র গণ অভ্যুত্থানের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদ পদত্যাগ করেন। এরপর থেকে দিনটি স্বৈরাচার পতন দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ###
লেখক- সাবেক ছাত্রনেতা ও গণমাধ্যম কর্মী মৌলভীবাজার
Leave a Reply