জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব – এইবেলা
  1. admin@eibela.net : admin :
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ০৩:৩৮ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
 স্পেনের বার্সেলোনায় বিজনেস অ্যাসোসিয়েশনের ইফতার সম্পন্ন বড়লেখা সমাজসেবা অফিসের ‘সমাজকর্মী’ সুব্রত বিশ্বাসের পরলোকগমন : শোক প্রকাশ কুলাউড়ায় সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের উপশাখার উদ্বোধন জুড়ী ট্র্যাজেডি : সোনিয়ার মৃত্যুতে বেঁচে রইলো না আর কেউ কুলাউড়ায় এনার ধাক্কায় দুমড়ে মুচড়ে গেছে সিএনজি চালিত অটোরিক্সা আত্রাইয়ে যথাযোগ্য মর্যাদায় মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উদযাপিত বড়লেখায় স্বাধীনতা দিবসে ২শ’ দুস্থ পরিবারে ইফতার ও খাদ্যসামগ্রী দিল বিজিবি জুড়ীতে চালঘেষা বিদ্যুৎ লাইন শেষ করে দিল একটি পরিবার, অগ্নিদগ্ধ শিশু হাসপাতালে কাতরাচ্ছে বিজিবি শ্রীমঙ্গলের পক্ষ থেকে ৩শ পরিবারের মাঝে ইফতার ও খাদ্য সামগ্রী বিতরণ কমলগঞ্জে মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস পালিত

জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব

  • শুক্রবার, ২৬ জুন, ২০২০

মুহম্মদ আব্দুস সামাদ ::

সমাজে যে হারে ধর্মান্ধতা বিস্তার লাভ করছে আর উগ্রবাদ বিকশিত হচ্ছে তা দেখে শংকিত হওয়া ছাড়া কোনো উপায় দেখিনা। আমি নিয়মিত ফেইসবুক ব্যবহার করি। আমার বাসায় টেলিভিশন নেই। বাড়ন্ত দুই শিশুকে এই যন্ত্রের প্রতি অনুরক্ত করতে চাইনা বলে ডিশ লাইন বিচ্ছিন্ন করে রেখেছি। অনেকদিন খবরের কাগজ রাখা বাদ দিয়েছি। যেটুকু সময় পাই শিশুদের সাথেই বই পড়ে, গল্প বলে, দাবা খেলে কাটাই। তাই এই সামাজিক যোগাযগ মাধ্যমটিই আমার তথ্য পাওয়ার প্রধান উৎস।

আমার নিউসফিডে বেশকিছু ভিডিও আসে বিভিন্ন বক্তার ওয়াজের। বেশিরভাগ বক্তাকেই তাদের নিজস্ব ধারার বাইরের অন্য আলেমকে তীর্যক ভাষায় আক্রমণ করতে দেখি। কেউ কেউ অন্য মতধারার আলেমদেরকে কাফের বলতেও ছাড়েন না। যে ভাষায় তারা অন্যান্য জনপ্রিয় বক্তাকে আক্রমণ করেন আর সমালোচনা করেন সেটা দেখে আড়ষ্ট হয়ে যাই।

রাজনৈতিক ভিন্নমতের প্রতি মানুষের আক্রোশ ভয় জাগিয়ে দেয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পারস্পরিক মতামতের আদানপ্রদানে মানুষ যে ভাষায় অপরপক্ষকে সমালোচনা করছেন সেটা দেখলে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয়। আমাদের জাতীয় মনন আর রুচি বুঝতে হলে কিছু সেলিব্রিটি যেমন, সজীব ওয়াজেদ জয়, তারেক রহমান, মোহাম্মদ আরাফাত, জুনায়েদ পলক, আসিফ নজরুল, পিনাকি ভট্টাচার্য এরকম তরুণ কিছু ফেইসবুক সেলিব্রিটির ওয়াল ঘরে আসুন। জাতীয় মনন কোন দিকে যাচ্ছে তার গতিপ্রকৃতি অনুধাবন করতে পারবেন খুব সহজেই। সবচেয়ে আশংকার বিষয় হচ্ছে তরুণ প্রজন্ম। এইসব হাইটেক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর প্রধান ভোক্তা হচ্ছেন তরুণরা। আর তরুনেরা যে পথে যাত্রা শুরু করেছে সেটা দেখে শংকিত হতে হয়।

মানুষ পিটিয়ে মানুষ মেরে ফেলছে। গুজবের উপর ভিত্তি করে মানুষ মানুষ হত্যার নেশায় মেতে উঠছে। মানুষ ইচ্ছাকৃত গুজব ছড়াচ্ছে। ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়াছহে। ফটোশপ করে একটা বিশেষ ধর্মের মানুষের নাম ধারণ করে অপর ধর্মের অনুভূতিতে আঘাত দেয়া হচ্ছে। মিথ্যা খবর প্রচার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। মানুষ অজাচারে মেতে উঠছে। ব্যভিচার, অনৈতিক কার্যকলাপ বিস্তার লাভ করছে।
মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটছে। অন্যায়কারী, ঘুষখোর, দখলদার, চাঁদাবাজরা সমাজের উচ্চ আসন দখল করে আসছে। নীতির চর্চাকারী, সৎ মানুষদের কন্ঠ খুবই ক্ষীণ। অসৎদের বড় গলার আড়ালে চাপা পড়ছে সৎদের ক্ষীণ আওয়াজ। সবখানেই যেনো শকুনের এক মহা উল্লাস।

আমাদের সামিজ জীবনে, শিক্ষা ব্যবস্থায়, মূল্যবোধ ব্যবস্থায়, নৈতিক শিক্ষায় একটা বিগ পুশ দরকার। আগেকার দিনে মানুষ মুরুব্বি মানতো, গুরু-শিষ্য একটা ব্যাপার ছিলো। এখন আর গুরুদেরও সময় নেই শিষ্যদের সময় দেয়ার জন্য। আর শিষ্যরাও নিজেদেরকে অনেক জ্ঞানী ভাবেন, তারা গুরু ধরেন না। সমাজে জ্ঞানের আলোচনা, জ্ঞান সৃষ্টি আর বিকাশের জন্য উদ্যোগ নজরে পড়েনা। একটা রেনেসাঁ দরকার এই জনপদে।

রেনেসাঁসের অভিধানিক অর্থ হল পুনর্জন্ম বা পুনর্জাগরণ বা নবজাগরণ। এই যুগের ব্যাপ্তিকাল ছিল আনুমানিক চতু্র্দশ থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত। আধুনিক ইউরোপের উদ্ভবের ক্ষেত্রে রেনেসাঁস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি মূলত একটি দীর্ঘস্থায়ী সমাজ পরিবর্তন প্রক্রিয়া। এই রেনেসাঁসের ভেতর দিয়ে আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার উত্থান ঘটেছে এবং একইসঙ্গে অবসান ঘটেছে মধ্যযুগের।

ঢাকায় ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’ গড়ে ওঠে মুসলিম সাহিত্য সমাজের নেতৃত্বে। কাজী আব্দুল ওদুদ, আবুল হুসেন, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল ফজলের মতো মুক্তচিন্তার বাহকেরা ছিলেন এই আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তাদের একটি মুখপত্র বের হতো ‘শিখা’ নামে। এর প্রত্যেক সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা থাকত, ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।’তাই জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা দূর করতে এগিয়ে আসতে হবে আমাদেরকে।

রেনেসাঁস স্নাত মুক্ত চিন্তার বিকাশে অসামান্য ভূমিকা পালন করেছে যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানমনস্কতা। আজকের সমাজে আমরা যেনো পশ্চাদপদতার জয়গান গাচ্ছি। অন্ধ চিন্তা, কুসংস্কার আর বিজ্ঞানহীনতাকে উৎসাহ দিচ্ছি। এখনো মানুষ ঝাঁড়ফোক, গুজব আর পশ্চাদপদতারই জয়গান গায়। সমাজে এগুলো টিকে আছে। মানুষ প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে উচ্চ ডিগ্রী নিচ্ছে, কিন্তু বুদ্ধির মুক্তি মিলছে কি?

জীবন ভোগ-ত্যাগ বা বর্জন নয়। ভোগহীনতা উদাসীনতা, সুতরাং উচ্ছৃঙ্খলতার জনয়িত্রী। ভোগকে মেনে নিলেই ভোগের ইতরবিশেষ সম্বন্ধে সচেতন হওয়া যায়, আর তা হতে পারলেও মুক্তির স্বাদ তথা জীবনের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার স্বাদ লাভ করা যায়। যুক্তি বিচারের আলোকেই তা সম্ভব, অতএব যুক্তি বিচারের প্রয়োজনীয়তা অনিবার্য। যুক্তি বিচার অথবা বুদ্ধির শান্ত আলোকেই আমরা বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে পারি, আবেগের উনকানিতে নয়।

আত্মকেন্দ্রিকতার ভয়াবহতা বুদ্ধির ইঙ্গিতে উপলব্ধি হয়। ভলতেয়ার বলেছিলেন, ‘তোমার মতের সঙ্গে আমি একমত না হতে পারি, কিন্তু তোমার মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য আমি জীবন দিতে পারি।’ যুক্তির মূল চেতনাই এ উক্তিতে ফুটে উঠেছে। শুধু ব্যক্তিজীবনে নয়, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনেও যুক্তির অনুশীলন অপরিহার্য।

মুক্তচিন্তা, বিতর্ক ও গণতন্ত্র অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। গণতন্ত্রের মূলমন্ত্রই হচ্ছে পরমতের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহনশীল আচরণ। যুক্তির চর্চা আমাদের এই অনুশীলনই করায়। পছন্দ হোক বা না হোক, প্রতিপক্ষের বক্তব্য মন দিয়ে শোনার মাঝেই পরমতসহিষ্ণুতার সৌন্দর্য নিহিত।

এই পথ মসৃণ নয়। ইয়ং বেঙ্গল সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মহান ডিরোজিও। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি ছাত্রদের মধ্যে এত উৎসাহের সঞ্চার করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, তার সহায়তায় ১৮২৮ সালে তারা ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন’ নামে তাদের নিজস্ব একটি সাহিত্য ও বিতর্ক সংঘ প্রতিষ্ঠা করে। এ সংঘ শ্রেণিকক্ষের বাধানিষেধের বাইরে ডিরোজিওর পরিচালনায় তরুণদের মনোযোগ আকর্ষণকারী বিভিন্ন বিষয়ে স্বাধীনভাবে আলোচনা করার একটি সাধারণ মিলনস্থানের সংস্থান করে। অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন ছিল এক সফল উদ্যোগ এবং মানিকটোলার এক বাগান বাড়িতে এর পাক্ষিক সভাগুলি অনুষ্ঠিত হতো। এ সব সভায় বহু ছাত্র এবং কিছু উদারমনা ও জনহিতৈষী ইউরোপীয় ব্যক্তি যোগ দিতেন। এর সাফল্য ছাত্রদের কলকাতার বিভিন্ন এলাকায় একই ধরনের সংঘ প্রতিষ্ঠা করতে উৎসাহিত করেছিল। ডিরোজিও অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হলেও সদস্য হিসেবে অন্য সংঘগুলির অধিকাংশের সঙ্গেই জড়িত ছিলেন এবং সেগুলির কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে আগ্রহী ছিলেন।

সমাজ সংস্কার বিষয়ে প্রথাগত চিন্তাধারার বিরুদ্ধে যাওয়ায় হিন্দু কলেজের শিক্ষক পদ থেকে ডিরোজিওকে অপসারণ করার প্রস্তাব রাখা হয়। এই প্রস্তাব ৬-১ ভোটে অনুমোদিত হয়। ১৮৩১ সালের এপ্রিল মাসে ডিরোজিওকে হিন্দু কলেজ থেকে বরখাস্ত করা হয়। তার পদচ্যুতি অবশ্য প্রগতিবাদী আন্দোলনকে দমন করতে পারে নি। প্রকৃতপক্ষে ডিরোজিও এ ঘটনার পর নিজের মতামত প্রকাশে আগের চেয়ে বেশি স্বাধীন হয়ে পড়েন। তিনি তার ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখেন।

বহিস্কৃত হবার পরে ডিরোজিও অর্থকষ্টে পড়েন। ১৮৩১ সালের ২৬শে ডিসেম্বর তিনি কলেরায় মারা যান। গির্জা ও খ্রিষ্টধর্ম সম্পর্কে তার অভিমতের কারণে পার্ক স্ট্রিটের গোরস্থানে তাকে সমাহিত করতে বাঁধা দেওয়া হয়। গোরস্থানের ঠিক বাইরে তাকে সমাহিত করা হয়। আর আজ? তার মৃত্যুর প্রায় দুইশত বছর পরেও তাকে আমরা স্মরণ করছি শ্রদ্ধাভরে। মহৎকর্মই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। আর সত্য আর সুন্দরের বিরুদ্ধে অবস্থান মানুষকে আস্থাকূড়ে নিক্ষেপ করে।

আমাদের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এরকম ডিরোজিও দরকার। পাড়ায় পাড়ায় ডিরোজিও দরকার। বুদ্ধির মুক্তির আন্দোলন দরকার। একটা রেনেসাঁ দরকার।

মুহম্মদ আব্দুস সামাদ
শিক্ষা বিশেষজ্ঞ, উন্নয়নকর্মী, লেখক, প্রাবন্ধিক। Samadsust22@gmail.com

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published.

আরো সংবাদ পড়ুন
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০২২ - ২০২৪
Theme Customized By BreakingNews