মৃত ভেবে ফেলে দেয়া হয়েছিলো ভারতীয় সীমান্তে- ৩ বছর পর ভারত থেকে ফিরে আদালতে মামলা দায়ের-
এইবেলা, কুলাউড়া ::
আপন মামারা প্রাণে হত্যার উদ্দেশ্যে নির্মমভাবে হামলা চালায় শাহাজান মিয়া (২৩) এর উপর। মৃত ভেবে কুলাউড়া উপজেলার চাতলাপুর এলাকার ভারতীয় সীমান্তে ফেলে চলে যায়। এরপর কেটে যায় ৩ বছর। পরিবারের সবাই শাহাজানের আশা যখন ছেড়েই দিয়েছিলো। মাথায় মারত্মক জখমের চিহ্ন, এক হাত, এক কান ছাড়া ভারত থেকে ফিরে আসেন সেই শাহাজান। দিয়েছেন লোমহর্ষক ঘটনার বিবরণ আর মামলা দায়ের করেছেন আপন ৪ মামার বিরুদ্ধে মৌলভীবাজার আদালতে।
কুলাউড়া উপজেলার টিলাগাঁও ইউনিয়নের ডরিতাজপুর গ্রামের মানিক মিয়ার ছেলে শাহাজান। পেশায় একজন কৃষক। গত ২২ নভেম্বর মৌলভীবাজার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ৫নং আমলী আদালতে তার আপন ৪ মামাকে আসামী করে মামলা (নং- ৪৩৬/২১ ইং) দায়ের করেন। আসামীরা হলেন শাহাজানের মামা ওয়াছির মিয়া (৩৮), ফুরকান মিয়া (৩২), মবশ্বির মিয়া (৪৫), ইয়াছিন মিয়া (২৫) ও অজ্ঞাতনামা সিএনজি চালককে আসামী করা হয়। মামলাটি তদন্তের জন্য আদালত পিবিআইকে নির্দেশ দিয়েছেন।
মামলার এজাহার সূত্রে ও সরেজমিন শাহাজানের ফুফুর বাড়িতে গেলে জানা যায়, টিলাগাঁও ইউনিয়নের ডরিতাজপুর গ্রামের বাসিন্দা শাহজানের বাবা মানিক মিয়ার সাথে তার স্ত্রীর পারিবারিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয়। বিরোধের কারণে মানিক মিয়ার স্ত্রী খারাপ আচরণ করতে থাকেন। তখন মানিক মিয়ার ছেলে শাহাজান মিয়া পিতার পক্ষ নিয়ে তার মাকে বুঝানোর চেষ্টা করে। সেই কারণে শাহাজানের মামা ওয়াছির মিয়া, ফুরকান মিয়া, মবশ্বির মিয়া, ইয়াছিন মিয়া তার ওপর ক্ষিপ্ত হন। তখন শাহাজাহানের মামারা তাকে বিভিন্ন ধরণের ভয়ভীতি দেখিয়ে হত্যা করে লাশ গুম করার হুমকি দেন। কিন্তু শাহাজান তার বাবার পক্ষ নিয়ে কথা বললে তার মামারা তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে।
ঘটনার দিন অর্থাৎ ২০১৯ সালের ২৫ জানুয়ারি টিলাগাঁও ইউনিয়নের কামালপুরে হযরত শাহ ফয়জুল হক চিশতীর মাজারে একটি ওরুস মাহফিলে যায় শাহাজান। সেখান থেকে রাত ২টার সময় শাহাজানের মামা ইয়াছির মিয়া গোপন কথা আছে বলে তাকে আগে থেকে ওঁৎ পেতে থাকা একটি সিএনজি অটোরিকশায় তার অন্য মামাদের সহযোগিতায় জোরপূর্বক তুলেন। তারপর শাহজানের মামারা ধারালো অস্ত্র দিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে একটি নির্জন স্থানে নিয়ে গিয়ে এলোপাতাড়ি মারধর করেন। তার মামা ফুরকান মিয়া দা (বটি) দিয়ে গলায় কুপ দিলে শাহাজানের ডানহাতটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপর মামা ওয়াছির মিয়া দা দিয়ে মাথায় কুপ দিলে মাথার বামপাশের কিয়দংশসহ বাম কান শরীর থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মামা মবশি^র মিয়া তার হাতে থাকা ছুরি দিয়ে বুকে ২টি কুপ মারলে সেই কুপ বুকের নীচে পড়ে মারাত্মক জখম হয়। এরপর মামা ইয়াছিন মিয়া তার হাতে থাকা ছুরি দিয়ে বাম হাতে পর পর ২টি কুপ দিলে হাতের বিভিন্ন জায়গায় গুরুতর জখম হয়।
লোমহর্ষক হামলার এক পর্যায়ে শাহাজানের মামারা তাকে মৃত ভেবে শরীফপুর ইউনিয়নের চাতলাপুর সীমান্তে কাঁটাতারের ভেতরে ভারতের অংশ রেখে চলে আসে।
পরদিন সকালে সীমান্ত এলাকায় টহলরত ভারতীয় বিএসএফ শাহজানকে দেখতে পেয়ে উদ্ধার করে কৈলাশহর হাসপাতালে ভর্তি করে। প্রায় বছর খানেক কৈলাশহর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর উন্নত চিকিৎসার জন্য ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় মর্ডাণ সাইক্রিয়াটিক হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। সেখানে ২০২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে চলতি বছরের ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত চিকিৎসাধীন ছিলেন শাহাজান।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় জ্ঞান ফিরলে শাহাজান হাসপাতালের এক নার্সের মাধ্যমে ঘটনার বিষয়ে জানতে পারে শাহজান। পরে নার্সের মাধ্যমে দেশের বাড়িতে যোগাযোগ করেন। পরবর্তীতে ভারতীয় হাইকমিশনের সাথে বাংলাদেশের সহকারী হাই কমিশন (আগরতলা ত্রিপুরা) আলোচনাক্রমে ২২ অক্টোবর শাহাজানকে দেশে পাঠানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এরপর ১৮ নভেম্বর দেশে ফিরে আসেন শাহাজান। দেশে ফিরে ৪ মামাকে অভিযুক্ত করে আদালতে মামলা দায়ের করে। মামলা করার পরও ক্ষান্ত হয়নি শাহাজানের মামারা। মামলা তুলে নেয়ার জন্য বিভিন্ন ধরণের হুমকি দিচ্ছেন।
ভুক্তভোগী শাহাজান মিয়া অভিযোগ করে জানান, পারিবারিক অনেক বিষয় নিয়ে আমার বাবা ও মায়ের প্রায়শই ঝগড়া হতো। আমি বাবার পক্ষ নিয়ে কথা বলায় আমার মামারা আমার ওপর ক্ষিপ্ত হন। সেই আক্রোশের জেরে মামা ফুরকানের নেতৃত্বে অন্যরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে আমার মৃত্যু নিশ্চিত ভেবে চাতলাপুর সীমান্তে ফেলে আসেন।
তিনি আরও বলেন, আমি বাবাকে কৃষিকাজে সহযোগিতা করতাম। এখন আমার এক হাত ও এক কান নেই। আমি কিভাবে আমার বাকি জীবনটা পরিচালনা করবো। আমার জীবন এমন চরম দূর্বিসহ হয়ে উঠবে চিন্তাই করিনি। বিশেষ করে আমার মামারা এমন কাজ করবে ভাবতেও পারিনি।
শাহাজানের ফুফু রুপজান বিবি জানান, শাহাজান খুবই শান্ত ও সহজ সরল প্রকৃতির ছেলে। পরিবারে ৪ ভাই ও ১ বোনের মধ্যে সে দ্বিতীয়। দেড় বছর আমরা তাকে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেছি। এখন সে তার মামাদের ভয়ে আমার বাড়িতে রয়েছে। তিনি ঘটনার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।
শাহাজানের বাবা মানিক মিয়া জানান, তার ছেলে সুস্থ, সবলভাবে ওয়াজ মাহফিলে যাওয়ার কথা বলে তিন বছর আগে বাড়ি থেকে বের হয়। দেড় বছর পর স্থানীয় চেয়ারম্যানের মাধ্যমে জানতে পারি ছেলে ভারতে আছে। এখন সে সরকারের সহযোগিতায় দেশে ফিরেছে। আমার ছেলে ভয়ে বাড়িতে আসতে চায়নি, তাকে আমার বোনের বাড়িতে রেখেছি। এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে ন্যায়বিচার দাবি করছি।
অভিযুক্ত শাহাজানের মামা ওয়াছির মিয়া তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, শাহাজান একজন মানসিক ভারসাম্যহীন। ভারসাম্যহীন অবস্থায় পরিবারের সবার অগোচরে সে বাড়ি থেকে বের হয়ে কোথায় গেছে সেটা আমরা জানিনা। আমরা কেন তাকে মারতে যাবো, তৃতীয় পক্ষ কেউ আমাদের ফাঁসাতে এমন ষড়যন্ত্র করছে। প্রশাসন তদন্ত করে প্রকৃত ঘটনার রহস্য উন্মোচন করবে।
এ ব্যাপারে কুলাউড়া থানার অফিসার্স ইনর্চাজ বিনয় ভূষণ রায় জানান, শাহাজান আমার কাছে আসলে বিজ্ঞ আদালতে মামলা করার পরামর্শ দেই। আদালত থেকে নির্দেশনা আসলে আমরা প্রয়োজনীয় আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পিবিআই মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার মোঃ আবু ইউসুফ জানান, এ ঘটনায় বিজ্ঞ আদালত থেকে তন্তের কোন নির্দেশনা পাইনি। পেলে তদন্তপূর্বক প্রয়োজনীয় আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে ২৫ জানুয়ারি ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ কুলাউড়ার চাতলাপুর সীমান্ত থেকে হাত, কান এবং মাথার একাংশ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় শাহাজানকে উদ্ধার করে ত্রিপুরা রাজ্যের কৈলাশহর হাসপাতালে পাঠায়। সেখান থেকে আগরতলা মর্ডাণ সাইক্রিয়াটিক হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেসে নিয়ে দু’দেশের হাইকমিশনের সহযোগিতায় ছয়জন প্রতিবন্ধীদের সাথে গত বৃহস্পতিবার (১৮ নভেম্বর) দুপুরে এক হাত ও এক কান কাটা অবস্থায় শাহাজানকে ফিরে পায় তার পরিবার। #
Leave a Reply