এইবেলা, কুলাউড়া :: প্রতিবছরের মত এবারও শীতের প্রকোপ বেড়েছে। আর তীব্র এই শীতে সমাজের অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকের চেয়ে বেদে সম্প্রদায়ের লোকগুলো সবচেয়ে বেশি অসহায় থাকে। প্রয়োজনীয় শীতবস্ত্রের অভাবে শীতে কুপোকাত হয়ে শীতকালীন ঠা-াজনিত নানা রোগে ভোগেন তারা। যেখানে দু’বেলা দুমুঠো খাবার যোগাড় করতে সারাদিন হন্য হয়ে ঘুরতে হয় তাদের সেখানে শীতবস্ত্র যেন আকাশ থেকে চাঁদ নিয়ে আসার মত গল্পের মত।
কনকনে শীতের রাত। তারমধ্যে চারিদিকে ঘন কুয়াশা। ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত সাড়ে ১১টা পেরিয়েছে। তীব্র শীতের কুয়াশায় সবাই নাস্তানাবুদ। সারাদিনের কাজের ক্লান্তির পর পলিথিন দিয়ে মোড়ানো ঘরে কোনো মতে ঘুমিয়ে পড়েছেন বেদে সম্প্রদায়ের পরিবারগুলো। বাস্তব জীবনে বেদে লোকজনের খোঁজ সমাজের কয়জনই বা রাখেন? তেমনি মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার কয়েকটি বেদে সম্প্রদায়ের পরিবারের খবর রাখেনা কেউ। উপজেলার চাতলগাঁও এলাকা, আলালপুর, সহ বিভিন্ন এলাকায় বসবাস করছেন প্রায় ১৫টি বেদে পরিবার। কিন্তু এবার তাদের খোঁজ রেখেছেন কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মাহমুদুর রহমান খোন্দকার। কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই বুধবার রাতে উপজেলার বিভিন্ন বেদে পল্লীতে তাদের কষ্ট স্বচক্ষে দেখতে বের হন ইউএনও মাহমুদুর রহমান খোন্দকার। প্রচ- শীতের প্রকোপ থেকে আত্মরক্ষার জন্য তাদের নেই ন্যুনতম শীতবস্ত্র। বেদে পল্লীতে তখন ঘুমের নিস্তব্ধতা। এমন সময় হঠাৎ বেদে পল্লীর দরজায় কড়া নাড়িয়ে একজন বললেন ইউএনও স্যার আপনাদের জন্য কম্বল নিয়ে এসেছেন। এসময় ইউএনও মাহমুদুর রহমান খোন্দকার উপজেলার চাতলগাঁও, আলালপুর এলাকায় অবস্থিত বেদে পল্লীর প্রায় ১৫ টি পরিবারের সদস্যদের মাঝে শীতবস্ত্র কম্বল বিতরণ করেন। এসময় কথা হয় বেদে সম্প্রদায়ের মহিলা আমিরুন নেছা (৪৫), জাহানারা বেগম (৩০), নাজমা বেগম (২৮) ও রবিউল মিয়া (৪৬) এর সাথে। তাদের সকলের বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলায়। তারা প্রত্যেকেই জানালেন, প্রায় দশ বছর ধরে কুলাউড়ায় বসবাস করছেন। সিঙ্গা লাগানো, দাঁতের পোঁকা ফেলানো এসব করে জীবিকা তারা নির্বাহ করে থাকেন। আর কিছু মহিলা মেয়েদের চুড়ি, ফিতা বিক্রি করে থাকে। আর বেদে পুরুষরা সাপের খেলা দেখায়, পানি থেকে সোনা রুপা তুলে এবং কড়ি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
বেদে পরিবারের লোকজন বলেন, উনি (ইউএনও) আমাগো দুঃখ-কষ্টের কথা চিন্তা করি কম্বল নিয়া আইছন। এখন শীতর জ্বালায় আমরা আর মরমু না। গতবছরও ইউএনও ফরহাদ স্যার করোনাকালীন সময়ে আমাদের পল্লীতে এসে আমাদের খাদ্য সহায়তা ও শীতবস্ত্র বিতরণ করেছেন। এরজন্য আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ইউএনও স্যারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। এদিকে আলালপুর এলাকায় বেদে পল্লীতে বসবাস করছেন জুড়ী উপজেলার হরিরামপুরের বাসিন্দা উমর আলী (৪৫)। তিনি স্ত্রীসহ ৭ ছেলে-মেয়ে নিয়ে কোনমতে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন। তাদেরকে শীতবস্ত্র তুলে দেন ইউএনও। এসময় ওই পরিবারের অসহায়ত্বের দৃশ্য দেখে উমর আলীর ভোটার আইডি কার্ডের কপি ও তাদের পরিবারের ছবি তুলে নেন ইউএনও মাহমুদুর রহমান খোন্দকার। তিনি তাদের জুড়ীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সাথে কথা বলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আশ্রয়ন প্রকল্প থেকে একটি ঘর পাইয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। এদিকে বেদে পল্লী থেকে কম্বল বিতরণ শেষে কুলাউড়ার কাদিপুর ইউনিয়নের গুপ্তগ্রাম এলাকায় শহর উল্ল্যাহ (৬৫), জুনেদ আহমদ (৪৬) সহ প্রায় ১০টি পরিবারে কম্বল বিতরণ করেন ইউএনও।
এদিকে সারাদিন হন্য হয়ে ঘোরাঘুরি করে স্টেশনের প্লাটফর্মে ঘুমিয়ে পড়েছেন বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা ছিন্নমূল মানুষরা। যেন কেউ নেই তাদের। এমন সময় হঠাৎ করেই রাত সাড়ে দশটায় তাদের দরজায় কড়া নাড়িয়ে একজন বললেন ইউএনও স্যার আপনাদের জন্য শীতের কাপড় (কম্বল) নিয়ে এসেছেন। এসময় সিলেটের কানাইঘাট এলাকার বাসিন্দা লুনা বেগম (৩৫), শ্রীমঙ্গল উপজেলার বাসিন্দা খোদেজা বেগম (৬৪), কুলাউড়ার জয়চন্ডী ইউনিয়নের রহমত আলী (৪৫), পৌরসভার জয়পাশা এলাকার সালেহা খাতুন (৫২) সহ অর্ধ শতাধিক নারী পুরুষ স্টেশন প্লাটফর্মে বসে শীতে কাতরাচ্ছেন। একটু এগিয়ে এসে দেখেন ইউএনও মাহমুদুর রহমান খোন্দকার তাদের জন্য কম্বল নিয়ে এসেছেন। কম্বল হাতে পেয়ে তারা সবাই প্রতিবেদককে বলেন, ‘উনারা আমাগো কষ্টর জ্বালা হুনিয়া দেখতা আইছন, আমাগো অবস্থা দেইখ্যা তারা কম্বল দিসইন। এখন আমরা সবাই শীতর কষ্টের জ্বালা থাকি বাঁচতাম পারমু’। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের বরাদ্দ থেকে উপহার হিসেবে কম্বলগুলো পেয়ে তারা সকলেই বেজায় খুশি। তারা সবাই বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য মন খুলে দোয়া করি, উনাকে যেন আল্লাহ পাক সবসময় ভালো রাখেন।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই বুধবার (২১ ডিসেম্বর) রাত সাড়ে দশটায় কুলাউড়ার রেলওয়ে স্টেশন প্লাটফর্ম ও বেদে পল্লীর ছিন্নমূল মানুষদের কষ্ট স্বচক্ষে দেখতে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বের হন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মাহমুদুর রহমান খোন্দকার। এসময় তাঁর সাথে ছিলেন উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা মোঃ ফজরুল ইসলাম, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. শিমুল আলী, ইউআরসি ইন্সট্রাক্টর মোঃ মহিব উল্ল্যাহ, কালের কণ্ঠ প্রতিনিধি মাহফুজ শাকিল, আজকের পত্রিকার প্রতিনিধি শাহ আলম সুমন, কালের কণ্ঠ শুভসংঘ কুলাউড়া শাখার সাধারণ সম্পাদক মহি উদ্দিন রিপন, সাংগঠনিক সম্পাদক আজহার মুনিম শাফিন প্রমুখ।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মাহমুদুর রহমান খোন্দকার বলেন, কুলাউড়া উপজেলায় প্রচন্ড শীত পড়েছে। প্রথমে কুলাউড়া রেলস্টেশন প্লাটফর্মে বসবাসরত মানুষের শীতের কষ্ট স্বচক্ষে দেখার জন্য তাদের কাছে কম্বল নিয়ে যাই। এরপর উপজেলার কয়েকটি বেদে পল্লীতে গিয়ে তাদের শীতের কষ্ট স্বচক্ষে দেখি। তখন তাদের প্রত্যেককে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে পাওয়া কম্বলগুলো উপহার হিসেবে দেয়া হয়েছে। বেদে পল্লী ও স্টেশন এলাকা মিলে প্রায় ১২০ জনকে শীতবস্ত্র দেয়া হয়েছে। এছাড়া উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের কাছে উপহারের কম্বল হস্তান্তর করা হয়েছে। এরপরও বাদ পড়া ছিন্নমূল মানুষদের খোঁজে খোঁজে সরাসরি কম্বল হাতে পৌঁছে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছি। পর্যায়ক্রমে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত ছিন্নমূল মানুষদের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হবে।#
Leave a Reply