বিশেষ প্রতিনিধি, ঢাকা :: চা বাগান শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন ও দাবির প্রতি সংহতি প্রকাশ করে সমর্থন জানিয়েছেন জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন।
শনিবার (২০ অাগস্ট ২০২২) এক যুক্ত বিবৃতিতে জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি কামরূল আহসান ও সাধারণ সম্পাদক আমিরুল হক আমিন বলেন, “গত ৯ আগস্ট থেকে চা বাগানের শ্রমিকরা ৩শ টাকা মজুরির দাবিতে আন্দোলন করছেন।
গত ক‘দিন যাবৎ ত্রিপক্ষীয় সভায়ও বিষয়টির সুরাহা করা যায়নি। মালিকপক্ষ শ্রমিকদের দাবির বিপরীতে মাত্র ১৪ টাকা মজুরি বাড়ানোর কথা বলেছে। বর্তমানে চা শ্রমিকদের যে মজুরী, বিদ্যমান উচ্চমূল্যের বাজারে কখনই তা জীবন-যাপনের উপযোগী মজুরি হতে পারে না।
বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশে বৃটিশ শাসিত ঔপনিবেশিক নীতিতেই চা বাগানগুলো পরিচালিত হচ্ছে, যা কখনই মানবিক হতে পারে না। একজন শ্রমিক যে হারে মজুরী পাচ্ছেন, তা দিয়ে শ্রমিক ও তার নির্ভরশীল পরিবারের ভরণপোষণ করা যায় না। অথচ শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবিকে অযৌক্তিক উল্লেখ করে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের রেশন সুবিধার অবান্তর প্রশ্ন তুলছেন।
যদিও এই রেশন ও বর্ধিত মূল্য পরিশোধে শুভঙ্করের ফাঁকির বিষয়টি বুঝতে কারও অসুবিধা হয় না। কেননা বহুদিন থেকেই শ্রমিকরা অভিযোগ করে আসছেন যে, রেশনে যে চাল বা আটা দেওয়া হয় তা কখনই ঘোষিত পরিমাপের পরিমাণ পাওয়া যায় না। অপরদিকে বেশি সংখ্যক শ্রমিকই ২৩ কেজি পাতা তুলতে পারেন না।
এক্ষেত্রে যে পরিমাণ কম তোলা হয় এবং তার বিপরীতে যে টাকা দৈনিক মজুরি থেকে কেটে নেওয়া হয়, সেটি বাড়তি পাতার জন্য প্রদেয় মূল্যের চাইতে অনেক বেশি। এই শুভঙ্করের ফাঁকির বিষয়টি মালিকপক্ষ বরাবরই এড়িয়ে যান!
বিবৃতিতে তারা বলেন, প্রায় ২শ বছর আগে যাত্রা শুরু করা এই শিল্পের শ্রমিকরা এখনও মানবেতর শোষণের শিকার হচ্ছে, যা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন।
তারা বলেন, চা বাগানের শ্রমিকদের সকল প্রকার শোষণ থেকে মুক্তির জন্য সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে- শ্রমিকের মৌলিক প্রয়োজনের যোগান নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য বাগান শ্রমিকদের
ও তার পরিবার-পরিজন প্রয়োজনীয় খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যা সভ্য সমাজে কাম্য হতে পারে না। এই বৈষম্য দূর করতে হবে, এ জন্য সরকারকেই কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে।
বিবৃতিতে তারা, চা বাগানের শ্রমিকরা ৩শ টাকা মজুরির যে দাবি তুলেছেন, মেনে নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহবান জানান এবং বাজার মূল্যের সাথে সামঞ্জস্যপুর্ণ মজুরি সমন্বয়ের স্থায়ী কাঠামো গড়ে তোলার আহবান জানান।
মজুরী বৃদ্ধিসহ অন্যান্য দাবীনামা নিয়ে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সম্পাদনের দাবিতে চলমান শান্তিপূর্ণ চা শ্রমিকদের অভূতপূর্ব আন্দোলনের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির মৌলভীবাজার জেলা সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য, সাপ্তাহিক নতুন কথার বিশেষ প্রতিনিধি, আরপি নিউজের সম্পাদক ও বিশিষ্ট কলামিস্ট কমরেড সৈয়দ আমিরুজ্জামান আলাপ আলোচনার মাধ্যমে মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন উপযোগী যৌক্তিক মজুরি নির্ধারণের আহবান জানিয়েছেন।
সামান্য কিছু সুযোগ-সুবিধাসহ দৈনিক মাত্র ১২০ টাকা মজুরিতে আট ঘন্টা, কখনো-বা আরো অধিক সময় ধরে কাজের বিপরীতে এই সামান্য পারিশ্রমিক শোষণ-বৈষম্যমূলক ও সংবিধান পরিপন্থি।
মজুরী বৃদ্ধিসহ অন্যান্য দাবীনামা নিয়ে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সম্পাদনের জন্য চলমান দরকষাকষির আলোচনার মাধ্যমে গড়ে ওঠা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে বাগান মালিকদের ঔপনিবেশিক মানসিকতা পরিহার করতে হবে ও সরকারকেও চা-শ্রমিকদের দেশের নাগরিক হিসেবে গণ্য করে ন্যায্য ও মানবিক উদ্যোগ নিতে হবে।
একইসাথে, চা বাগানের শ্রমিকদের জন্য প্রযোজ্য শ্রম আইনের কার্যকর বাস্তবায়নের পাশাপাশি দেশের অন্যান্য সম-পর্যায়ের খাতের সর্বনিম্ন মজুরি বিবেচনায় নিয়ে মর্যাদাপূর্ণ জীবন ধারণের উপযুক্ত ও চা-শ্রমিকদের নিকট গ্রহণযোগ্য ন্যায্য পারিশ্রমিক নির্ধারণে বাগান মালিক, বাংলাদেশীয় চা সংসদ, শ্রম অধিদপ্তর ও সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন তিনি।
প্রতি দুই বছর পরপর চা-শ্রমিক ও বাগান কর্তৃপক্ষের মধ্যে মজুরি সংক্রান্ত চুক্তি নবায়নের রীতি রয়েছে, যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে মজুরি নির্ধারণে বাস্তবে একতরফাভাবে বাগান কর্তৃপক্ষই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে, তথাপি গত ১৯ মাস ধরে চা-শ্রমিকরা মজুরি চুক্তির বাইরে রয়েছে। দ্রব্যমূল্যের চরম ঊর্ধ্বগতির এই সময় চলমান আন্দোলনের প্রেক্ষিতে মাত্র ২০ টাকা মজুরি বৃদ্ধির প্রস্তাব চা-শ্রমিকদের ন্যায্য দাবির প্রতি অবজ্ঞা ও নিছক উপহাসমূলক অধিকার লঙ্ঘন ছাড়া আর কিছু নয় উল্লেখ করে তিনি বলছেন, চা-শ্রমিকদের প্রাপ্ত আবাসনসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় নিয়েও একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, দেশের অন্য যে-কোনো খাতের তুলনায় চা শ্রমিকদের মজুরি সর্বনিম্ন ও শোষণ-বৈষম্যমূলক। অথচ সার্বিক বিবেচনায় এ খাতটি অর্থনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তাছাড়া, এখন পর্যন্ত কোনো পরিসংখ্যান বা তথ্য-উপাত্ত দিয়েও কেউ বলতে পারেননি যে, চা-বাগানের মালিক পক্ষ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বা এমন কোনো অবস্থায় আছেন যে, যাদের অবদানের ওপর নির্ভর করে চা-শিল্প বিকাশমান, সেই শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি প্রদানে তারা অক্ষম। বরং এটি একটি লাভজনক বাণিজ্যিক খাত। অন্যদিকে চা-শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরিসহ অন্যান্য মৌলিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার দায়িত্ব শুধু মালিকপক্ষের মর্জির ওপর ছেড়ে দেয়া ঠিক নয়। চা শ্রমিকদের দেশের নাগরিক হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে তাদের প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সমূহকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে চলমান আন্দোলনের যৌক্তিকতা অনুধাবনের পাশাপাশি সমতাভিত্তিক আলোচনার মাধ্যমে চা শ্রমিকদের নিকট গ্রহণযোগ্য মজুরি নির্ধারণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।’
তিনি বলেন, দেশের “ন্যূনতম মজুরি বোর্ড” অন্যান্য খাতের ন্যূনতম মজুরি যেখানে কয়েক গুণ বেশি নির্ধারণ করেছে, সেখানে কোন অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে শ্রম মন্ত্রণালয়ের “গাইড লাইন” উপেক্ষা করে বারবার চা বাগান মালিক পক্ষের নির্ধারণ করা ন্যূনতম মজুরির হার বহাল রেখে শ্রম মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করছে, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
Leave a Reply