এইবেলা, বড়লেখা :
জীবন যুদ্ধে অনেক বাধা বিপত্তির সামনে মাথা নুইয়ে থেমে যাওয়ার উদাহরণ অনেক। তবে সেই যুদ্ধকে জয় করে, সব বাধাকে পেরিয়ে আবারও সামনে চলার পথ খুঁজে পাওয়া এবং অনেক দূর এগিয়ে যাওয়া এই গল্পগুলো আমাদের অনুপ্রেরণা যোগায়। তেমনি সব বাধা, সীমাবদ্ধতা, প্রতিকূলতাকে পেরিয়ে এগিয়ে যাওয়া সফল এক যুবক হচ্ছেন সুমন দেবনাথ। সুমন শুধু নিজের জীবনের পরিবর্তন ঘটাননি। বদলে দিয়েছেন তার উপজেলার আরও কিছু বেকার যুবকের হতাশার চিত্র। বেকার যুবকদের কাছে সুমন হয়ে উঠেছেন অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় দৃষ্টান্তরূপে। তার বাড়ি মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার নিজ বাহাদুরপুর ইউনিয়নের ভাগাডহর গ্রামে।
জানা গেছে, সুমনের বাবার ৫ একরের মতো জায়গা-জমি থাকলেও সংসারে আর্থিক টানাপোড়েন ছিল। ২০১২ সালের ঘটনা। সুমন তখন এসএসসি পরীক্ষার্থী। অর্থ সংকটে ওই বছর পরীক্ষা দিতে পারেননি। এতে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। ওই অল্প লেখাপড়ায় চাকরি পাওয়াও কঠিন। তিনি কী করবেন এই ভেবে যখন দিশেহারা তখন তার গ্রামের এক বড় ভাইয়ের তথ্যমতে ও বড়লেখা উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তার আন্তরিক সহযোগিতায় ‘গবাদি-পশু, হাঁস মুরগি পালন, মৎস্য চাষ এবং কৃষি বিষয়ক’ ৩ মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পরে যুব উন্নয়ন কর্মকর্তার পরামর্শে ও সহযোগিতায় যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে ২৫ হাজার টাকার যুব ঋণ গ্রহণ করেন। পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে আরও কিছু টাকা ধার নিয়ে ২০১৪ সালে ৩০০ পোলট্রি মুরগির খামার করেন। শুরু ও চলার পথটা কিন্তু মোটেই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না তার। মানুষের কটাক্ষ, জীবনের দুঃখÑকষ্টকে শক্তিতে পরিণত করে এগিয়ে চলেন। লাভ-লোকসানের মধ্য দিয়েই এভাবে তাঁর কেটে যায় প্রায় ৫ বছর। ২০১৮ সালের দিকে ১০০০ হাজার লেয়ার মুরগির খামার করেন। দিনে দিনে ডিমের উৎপাদন বাড়তে থাকে। বাড়ে খামারের পরিসর। বর্তমানে তার খামারে ২০০০ হাজার লেয়ার মুরগি আছে। এর মধ্যে খামারের ডালপালা মেলে। খামারের পাশের জমিতে পুকুর কেটে মাছ চাষ করেন। পাশাপাশি আগর বাগান, কমলা-লেবু, লটকন, কলা ও সবজির চাষ করছেন। এসবে দেখেন সফলতার মুখ। সব খরচ বাদে তার মাসিক আয় এখন ১ লাখ টাকার উপরে। ২০২২ সালে বড়লেখায় উপজেলা পর্যায়ে সফল আত্মকর্মীর পুরস্কার পেয়েছেন। এরই মধ্যে লেখাপড়া করছেন স্নাতক তৃতীয় বর্ষে। তার দেখাদেখি ও পরামর্শে উপজেলার প্রায় ২০ জনের মতো যুবক খামার করেছেন। তারাও সফল আত্মকর্মী হয়েছেন। এসবের পাশাপাশি বৃক্ষরোপণ, সামাজিক ও জনসচেতনতামূলক কাজও করছেন।
সুমন দেবনাথ বলেন, ‘আমার অনেক কষ্টের মধ্যে যুব উন্নয়ন আশার আলো দেখিয়েছে। যুব উন্নয়নের দেওয়া প্রশিক্ষণ ও ঋণ দিয়ে আমি খামার শুরু করি। শুরুতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। কিন্তু থেমে যাইনি। এখন লেয়ার মুরগির পাশাপাশি মাছের খামার, আগর বাগান, কমলা-লেবু, লকটন, কলা ও সবজির চাষ করি। এসবে আমি সফল হতে পারিনি। আমি বিশ^াস করি যে যেটাই করুক তার পেশার প্রতি যদি ভালোবাসা তৈরি হয়, তাহলে ভালো কিছু পাওয়া সম্ভব।’
আলাপকালে পোল্ট্রি কনসালটেন্ট ডা. দেওয়ান মো. মাহবুবুর রাজীব বলেন, ‘সুমনের খামারের পরিবেশটা খুবই সুন্দর। আমি তার খামারের মুরগির চিকিৎসা সংক্রান্তে সব সময় সহযোগিতা করি। এইরকম প্রাকৃতিক পরিবেশের খামারের বায়োসিকিউরিটি ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ হয়, বিধায় মুরগিতে রোগব্যাধিও কম থাকে। এতে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার খুবই সীমিত। যা জনস্বাস্থ্যের উপকারী। ফলে এখানকার ডিম ও মাংস গুণগত মান সম্পন্ন।’
উপজেলা সহকারী যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা পুর্ণেন্দু কুমার দত্ত বলেন, ‘সুমন যুব উন্নয়নের মাধ্যমে ৩ মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে খামার শুরু করেন। আমরা শুরু থেকেই তাকে নানাভাবে সহযোগিতা করছি। সে আত্মবিশ্বাস ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সফল হয়েছে। বর্তমানে তার মাসিক আয় লাখ টাকার উপরে। তার দেখাদেখি ও পরামর্শে প্রায় ২০ জন যুবক খামার করে সফল হয়েছে।’
Leave a Reply