বিশেষ প্রতিনিধি:
কুলাউড়া উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা সৌমিত্র কর্মকার ২০২৩ সালের জয়িতা অন্বেষণে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এমন চারজন নারীকে খুঁজে বের করেছেন যারা কঠোর পরিশ্রম, ধৈর্য্য, সাহস আর লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে প্রতিকুলতা ডিঙিয়ে জীবন সংগ্রামে বিজয়ী ও প্রতিষ্ঠালাভ করেছেন।
অর্থনৈতিক, শিক্ষা ও চাকুরী, সংসার ও নারী নির্যাতনের বিভীষিকা মূছে ফেলে ঘুরে দাঁড়ানো এই চার নারীকে গত বেগম রোকেয়া দিবসে প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে সম্মাননা সনদ ও ক্রেষ্ট। এরা হলেন হাসিনা আক্তার ডলি, চুমকি মালাকার, বাণী শর্মা ও মনি কানু।
অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী হাসিনা আক্তার ডলি : নিতান্ত নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে হাসিনা আক্তার ডলি। বাবা ছিলেন ইউপি সদস্য। অল্প বয়সে বাবা তাকে বিবাহ দিয়ে দেন। বিবাহের পর জীবন স্বাভাবিকভাবে চলছিল। হটাৎ স্বামী মারা যাওয়ায় জীবনে নেমে আসে চরম হতাশা। নিয়মিত আয় রোজগার না থাকায় সংসারের চাকা সচল রাখতে রীতিমত হিমশিম খেতে হতো তাকে। এসময় তিনি পারিবারিক এবং সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হন। পরবর্তীতে তিনি দ্বিতীয় বিবাহে আবদ্ধ হন। স্বামীর নাম বাতীর আলী। ২য় স্বামীর সহযোগিতায় তিনি ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হন। বাড়িতে যে জায়গা জমি আছে সেগুলোকে কাজে লাগান। তিনি তার ছেলের নামে একটি পোল্ট্রি ফার্ম তৈরী করেন। সেখানে ৩ থেকে ৪জন লোক নিয়মিত কাজ করে। তাদেরকে তিনি উপযুক্ত পারিশ্রমিক প্রদান করেন। স্বামীর সাথে যৌথভাবে ফিসারিজ ফার্ম শুরু করেন। বর্তমানে তাদের তিনটি মৎস্য খামার চলমান রয়েছে। সেখানেও বেশ কিছু লোকের কর্মসংস্থানর হচ্ছে। তিনি বাণিজ্যিকভাবে শাক-সবজিরও চাষ করেন। সবগুলো প্রজেক্ট হতে তিনি ভালো আয় রোজগার করছেন। গড়ে তোলা পোল্ট্রি ফার্ম, ফিসারি ও সবজি বাগানে তিন ছেলেমেয়ে, স্বামীসহ আরো অনেকে কাজ করেন। এখানে কাজ করে প্রত্যেকেই আজ স্বাবলম্বী। তিনি ব্যবসার পাশাপাশি সমাজসেবা মূলক কাজেও অংশগ্রহণ করে থাকেন। তিনি গরীব অসহায় মানুষদেরকে সাধ্যমত সাহায্য সহযোগিতাও করে যাচ্ছেন। তার এই জনকল্যাণ মূলক কাজ ও মানবিক গুনাবলীর কারণে এলাকার লোকজন তাকে কুলউড়া সদর ইউনিয়নে সংরক্ষিত আসনে মহিলা সদস্য হিসাবে নির্বাচিত করেছে। তিনি একাধারে একজন সমাজসেবক অপরদিকে একজন সফল নারী উদ্যোক্তা। অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী হিসাবে সমাজে তিনি এখন দৃষ্টান্ত।
শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী চুমকি মালাকার : কুলাউড়া উপজেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্মগ্রহণকারী চুমকি মালাকারের পিতা ছিলেন দরিদ্র রিক্সা চালক। মা গৃহীনি। পিতার সামান্য রোজগারে কোনমতে সংসার চলতো। এক ভাই তিনবোনের মধ্যে তিনি হলেন দ্বিতীয়। আর্থিক টানাপোড়েন ও শত বাঁধা বিপত্তি স্বত্তেও তিনি নিজের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় লেখাপড়া চালিয়ে যান। তিনি কুলাউড়ার ইয়াকুব তাজুল মহিলা ডিগ্রী কলেজ হতে ২০১৮ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে অনার্স করেন। সংসারের চাকা সচল রাখতে তিনি বিভিন্ন যায়গায় চাকরীর অনুসন্ধান করতে থাকেন। পাশাপাশি তিনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরির প্রস্তুতি নেন। একসময় তার প্রচেষ্টা সফল হয়। তিনি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষক পদে চাকরি পেয়ে যান। বর্তমানে তিনি কর্মধা ইউনিয়নের নজরুল এনাম সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষক পদে কর্মরত। সংসারের চাকা সচল রাখা ছোট বোনদের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়াসহ সমস্থ কিছুর হাল ধরেন তিনি। তার ছোট দুই বোনের একজন সিলেট এমসি কলেজে অনার্স পড়ছে। অপর ছোটবোন এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী। জীবন সংগ্রামে সফল নারী চুমকি মালাকার চাকরির পাশাপাশি মাষ্টার্সে অধ্যয়নরত। বর্তমানে তার বাবা আর রিক্সা চালন না। চুমকি মালাকারের জীবন সংগ্রাম, তার পথ চলা, শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে তার সাফল্য নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অনুকরনীয় ও অনুসরনীয় দৃষ্টান্ত।
সফল জননী নারী বাণী শর্মা: কুলাউড়ার অজো পাড়াগাঁয়ে জন্ম বানী শর্মার বিয়ে হয় একজন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের সাথে। তিনি দুটি ছেলে সন্তানের জননী হন। যৌথ পরিবারের সংসার পরিচালনা করতে বাণী শর্মাকে রীতিমত হিমশিম খেতে হয়। সন্তানদের সঠিকভাবে লালন পালন করতে তাকে দিন রাত প্রচন্ড পরিশ্রম করতে হয়। সংসারে আর্থিক স্বচ্ছলতা না থাকায় তিনি নিজে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে চাকরি নেন। বর্তমানে তিনি অফিস সহকারি কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে কর্মরত। তিনি একদিকে সংসার স্বামী-সন্তান, অন্যদিকে অফিসের দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে এক হাতে সামলিয়েছেন। তিনি তার দুই সন্তানকে কিভাবে মানুষের মত মানুষ করবেন, এই চিন্তায় সবসময় ব্যাকুল থাকতেন। তিনি অনেক কষ্ট করে হলেও তার ছেলেদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। বাণী শর্মার প্রথম সন্তান অভিজিৎ চক্রবর্তী বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি (বুয়েট) হতে কৃতিত্বের সাথে ২০২২ সালে ১ম শ্রেনীতে অনার্স সম্পন্ন করেন। এরপর গত জুলাই ২০২৩ মাসে ক্লার্কসন ইউনিভার্সিটি, নিউইয়র্ক এ স্কলারশিপ নিয়ে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করার উদ্দেশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। তার ২য় সন্তান অভিষেক চক্রবর্তী কৃতিত্বের সাথে এসএসসি ও এইচএসসি সম্পন্ন করে সিলেট মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি হতে ১ম শ্রেনীতে অনার্স সম্পন্ন করেন। বর্তমানে তিনি একই ইউনিভার্সিটিতে মাষ্টার্স ডিগ্রী করছেন। কঠিন পরিস্থিতির মাঝে থেকে বাণী শর্মা তার সন্তানদের মানুষ করার জন্য যে লড়াই করেছেন এবং সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন তা সত্যই প্রসংশার দাবী রাখে। সাফল জননী নারী হিসাবে তিনি সমাজের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
সমাজ উন্নয়নে অবদান রাখা নারী মনি কানু : একজন সমাজ সেবক হিসাবে মনি কানু এলাকার যে কোন সমস্যা সমাধানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, যৌতুক বিরোধী আন্দোলন, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সংক্রান্ত বিষয় গুলিতে তিনি অত্যন্ত সোচ্চার। সরকারী বেসরকারী বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রমের সাথে এলাকার স্বল্প শিক্ষিত ও নিরক্ষর মহিলাদের তিনি সম্পৃক্ত করার কাজটি অত্যান্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করে যাচ্ছেন। তিনি এলাকার দরিদ্র অসহায় লোকজনকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলতে সাধ্যমত চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তিনি সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন উৎস হতে প্রাপ্ত টাকা দিয়ে গরু ছাগল হাঁস মুরগী ক্রয় করে গরীব লোকজনের মঝে বিতরণ করেন। মানুষের প্রতি তার দরদ এবং ভালোবাসার স্বীকৃতি স্বরূপ এলাকার জনগণ তাকে সংরক্ষিত মহিলা আসনে ইউপি সদস্য নির্বাচিত করেন। ইউপি সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর সমাজসেবার মত বিষয়টি তার কাছে আরো সহজ হয়ে যায়। তিনি আরো বেশী করে মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। তিনি এলাকার রাস্তা-ঘাট, পুল-কার্লভাট ইত্যাদি নির্মাণ ও উন্নয়নে জোড়ালো ভূমিকা রাখছেন। করোনা কালীন সময়ে তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাধারণ মানুষের দোর গোরায় গিয়েছেন। সকলের মাঝে মাস্ক, স্যানিটাইজার নিয়মিত বিতরণ করেছেন। মানুষজনকে সচেতন করেছেন। বন্যায় দুর্গত মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ত্রাণ বিতরণ করেছেন, যুগিয়েছেন সাহস। আর এইভাবেই সমাজে তিনি অবদান রেখে চলেছেন।
Leave a Reply