এইবেলা, কুলাউড়া :: মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় একটি বসতবাড়ির পাশের ডোবা থেকে স্কুল ছাত্রী দিলরুবা জান্নাত ফাহমিদা (১১) নামক এক শিশুর লাশ উদ্ধারের ১ মাস ১৪ দিন পেরিয়ে গেলেও ঘটনার মূলরহস্য উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। এই ঘটনায় কুলাউড়া থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়।
এদিকে নিহত ফাহমিদার মাতা ছইফা বেগম বাদী হয়ে স্থানীয় বাসিন্দা প্রবাসী আব্দুল কালামের ছেলে মুদি দোকানদার আবু বক্কর শাহাজান (২৫) কে প্রধান আসামী করে আদালতে একটি হত্যা মামলা (নং-৪৫৯/২২, তারিখঃ ১৯/০৯/২০২২) দায়ের করেন। মামলার অন্য আসামীরা হলেন- আব্দুল্লা মিয়ার ছেলে আব্দুল ওদুদ (৩০), আবু বক্করের মাতা রাবিয়া বেগম (৪৮), রইছ আলীর স্ত্রী সেলিনা বেগম (৩৫) ও মাসুম মিয়ার স্ত্রী শারমিন বেগম (২৬)। এ ঘটনায় আবু বক্কর শাহাজান ও তার মাতা রাবেয়া বেগম বাড়িঘর ছেড়ে গরু-ছাগল নিয়ে পালিয়ে গেছে। তাদের গ্রেফতারে পুলিশের নেই কোন তৎপরতা।
এর আগে গত ১১ সেপ্টেম্বর শনিবার দুপুরে উপজেলার টিলাগাঁও ইউনিয়নের কাজিরগাঁও গ্রামে ওই ছেলে আবু বক্কর শাহাজানের বসতবাড়ির পেছনে একটি ডোবা থেকে ফাহমিদার লাশ উদ্ধার করা হয়। ফাহমিদা একই এলাকার আকমল আলীর ২য় মেয়ে। সে রাউৎগাঁও উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ালেখা করতো। এ ঘটনায় বিদ্যালয়ের শত শত শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন করে জড়িত ব্যক্তিকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।
সরেজমিন টিলাগাঁও ইউনিয়নের কাজিরগাঁও এলাকায় গেলে জানা যায়, ভিকটিমের পরিবার ও স্থানীয় এলাকার মানুষের সন্দেহ, একই এলাকার ছেলে আবু বক্কর শাহাজান ফাহমিদাকে হত্যা করে পানির ডোবায় ডুবিয়ে রাখে। ঘটনার দিন সকাল ৯টা থেকে পলাতক হয় সেই ছেলেটি। পরদিন তার মাতাও বসতবাড়ির গবাদি পশুসহ বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। এতে প্রমাণ করে যে, তারা এই হত্যাকান্ডের সাথে সরাসরি জড়িত থাকতে পারে।
আদালতে দায়ের করা এজাহার ও ফাহমিদার মাতা ছইফা বেগম জানান, আমার বড় মেয়ে নাঈমা ও মেঝ মেয়ে ফাহমিদা সকাল ৮টায় পাশের বাড়ির বাসিন্দা আবু বক্কর শাহাজানের দোকানে চিনি আনতে যায়। এসময় আসামী শাহাজান আমার বড় মেয়ে নাঈমার কাছে চিনি দিয়ে আমার ছোট মেয়েকে তার মায়ের সাথে দরকার আছে বলে তাদের বাড়িতে ডেকে নেয়। তখন নাঈমা চিনি নিয়ে বাড়ি ফিরলেও আমি তাকে জিজ্ঞেস করি ফাহমিদা কোথায়। তখন সে আমাকে জানায় ফাহমিদা শাহাজানের বাড়িতে গেছে। প্রায় এক ঘন্টা পর মেয়েকে খোঁজাখুঁজি করার পর শাহাজানের বাড়িতে যাই। সেখানে গিয়ে শাহাজানকে ভিজা ও কাদাযুক্ত অবস্থায় দেখি। এসময় আমাকে দেখে আসামী শাহাজান হতবাক হয়ে যায়। আমি মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করলে শাহাজান অসংলগ্ন কথাবার্তা শুরু করে। এসময় শাহাজানের আচরণ সন্দেহজনক হলে মেয়েকে বাড়ির আশপাশ খুঁজতে থাকি। আমার চিৎকার শুনে আমার স্বামী আকমল মিয়া ক্ষেতের জমি থেকে দৌঁড়ে আসেন। এসময় বিবাদী শাহাজান দৌড়ে বাড়ি থেকে যাওয়ার সময় বলে তাদের ঘরের পাশে পানির খাল দেখিয়ে বলে যে, এইখানে খোঁজ করেন। বিবাদী শাহাজানের দেখানো জায়গায় আমার স্বামী এসে দেখতে পান কাদামাটি স্তুপকারে রয়েছে। তখন আমার স্বামীর সন্দেহ হলে ওই পানির ডোবাতে নেমে পা দিয়ে কাদা সরালে কাদার নিচে মেয়ে ফাহমিদাকে দেখতে পেয়ে চিৎকার শুরু করলে আশপাশের লোকজন এসে ফাহমিদাকে উদ্ধার করে বিবাদীর বাড়ির উঠোনে লাশ রাখা হয়। এসময় ভিকটিম ফাহমিদার ঘাড়ের মধ্যে লাল দাগ দেখা যায়। বিষয়টি তাৎক্ষণিক পুলিশকে খবর দিলে পুলিশ এসে ফাহমিদার লাশের সুরতহাল তৈরি করে। এসময় বিবাদী শাহাজানসহ সকল বিবাদীরা বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। আমার ধারনা শাহাজান ও তার মাতা রাবিয়া বেগম আমার নিষ্পাপ মেয়ে ফাহমিদাকে ঘরে ডেকে নিয়ে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে সকল বিবাদীদের সহযোগিতায় শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে তাদের বাড়ির পাশের ডোবায় কাদামাটিতে লাশ পুঁতে রাখে।
ফাহমিদার বড়বোন মাহবুবা জান্নাত নাঈমা বলেন, ঘটনার দিন আমার বোন ফাহমিদাকে নিয়ে আমি শাহাজানে দোকানে চিনি আনতে যাই। ওই ছেলে আমার সাথে অশ্লীল আচরণ করলে আমার ছোটবোন বিষয়টি আমার মাতাকে বলে দিবে বললে তার বাড়িতে তার মাতার দরকার আছে বলে ডেকে নেয়। পরে আমি চিনি নিয়ে বাড়িতে চলে আসি এবং আমার মাতাকে বিষয়টি অবগতি করি। অনেক খোঁজাখুঁজির পর বোনের লাশের খবর পাই। তখন ওই ছেলেটিকে কাপড় ভিজে অবস্থায় দেখতে পাই। এতে সন্দেহ হচ্ছে, সে এই ঘটনাটি ঘটিয়েছে। ওই ছেলেটি বখাটে প্রকৃতির ছিল। প্রায় সময় আমাদের সাথে খারাপ আচরণ করতো।
স্থানীয় কাজিরগাঁও এলাকার গ্রাম্য সর্দার আব্দুল কাদির বলেন, কে বা কারা এই ঘটনাটি ঘটিয়েছে আমরা জানিনা। তবে ঘটনার দিন শাহাজানের বাড়ির পাশে পানির ডোবা থেকে পুঁতে রাখা অবস্থায় ফাহমিদার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মরদেহ উদ্ধারের পূর্বে শাহাজান ও ঘটনার পরদিন তার মাতা বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। এতে আমাদের সন্দেহ হচ্ছে। বিষয়টি সমাধান করার জন্য শাহাজানের চাচা ও ফুফু আমার সাথে যোগাযোগ করেছেন। তারা বর্তমানে কোথায় আছে সেটা পুলিশ কিংবা এলাকার লোকজন কেউই জানেনা।
টিলাগাঁও ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আব্দুল মালিক ফজলু বলেন, ঘটনার দিন সকালে ১০টায় জানতে পারি ফাহমিদার লাশ ডোবায় পাওয়া গেছে। সরেজমিন সেখানে গিয়ে পুলিশকে বিষয়টি অবগতি করি। আমরা কেউই অনুমান করতে পারিনি কিভাবে দুর্ঘটনাটি ঘটিয়েছে। পরে তাৎক্ষণিক আমরা ধারণা করেছি কেউ না কেউ এমন ঘটনাটি ঘটিয়েছে। আমরা এখনও অপেক্ষা করছি ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আসার পর পুলিশের ভূমিকা কি হয় সেটা জানার জন্য।
তিনি আরও বলেন, ফাহমিদার পরিবারের সন্দেহ ছিল পাশের বাড়ির ওই ছেলেটি এই ঘটনাটি ঘটিয়েছে। যেহেতু ছেলে ও তার মাতা পলাতক রয়েছে সেহেতু তাদের সন্দেহের সাথে আমাদের সন্দেহের মোটামুটি মিল রয়েছে। এখন পুলিশ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করলে বিষয়টি সম্পর্কে পুরোপুরি জানা যাবে।
কুলাউড়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, ঘটনার দিন একটি পানির ডোবা থেকে ফাহমিদাকে মৃত অবস্থায় পায় তার পরিবারের লোকজন। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে তার লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে প্রেরণ করে। পরবর্তীতে ভিকটিম ফাহমিদার পিতা আকমল মিয়া বাদী হয়ে অপমৃত্যুর এজাহার দিলে থানায় অপমৃত্যু মামলা (নং-০২/১৮) দায়ের করা হয়। বর্তমানে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট প্রাপ্তির জন্য আবেদন করা হয়েছে। এখনো ময়না তদন্ত রিপোর্ট আসেনি। রিপোর্ট আসার পর মৃত্যুর মূল কারণ জানা যাবে। #
Leave a Reply