অ আ আবীর আকাশ ::
মায়ের কাছে শুনেছি, যখন আমি সাত আট বছরের ছিলাম তখন আমাদের পুরান বাড়িতে বাপ-চাচারা কয়েকজন মিলে ‘হাদুরিয়ার জারি’ বা হায়দার আলী বয়াতির জারি নিয়ে এসেছিলেন। তার সাথে ছিলেন মান্নান, মন্টু ও হাবু। তাদের ৪ জনের দল। এ নামগুলো মায়ের কাছ থেকেই পাওয়া। এরকম জারি ও পালা গানের আসর জমতো প্রায় বছরই। মা আমাকে সাথে করে রাতের প্রথম ভাগ জারি শুনেছিলেন। সে চিত্র আমার আবছা আবছা মনে আছে। সেই থেকে হাদুরিয়ার জারি বা ‘হায়দার আলী বয়াতি’ নামের সাথে পরিচয় হয়। পরবর্তীতে হাটে-বাজারে হায়দার আলী বয়াতির কথা শুনলে যতো তাড়াহুড়োই থাকতো একবার এক দন্ড না দাঁড়িয়ে, অনুষ্ঠান উপভোগ না করে আসতাম না।
গ্রামে শৈশব কৈশোর গ্রামে পার করাতে স্বর্ণালী সময়ের বহু জিনিস আমার উপভোগ করার সৌভাগ্য হয়েছে। উদোল জলে সাঁতার দেয়া, শ্রী খেলা, ডুব দিয়ে জলের তলে ইট বা পাথর লুকানো, গায়ে কাদা মেখে মেঘ-বৃষ্টি খেলা, পিছলা দেয়া, সুতোয় মাঞ্জা দিয়ে ঘুড়ি উড়ানো, জ্বীম ধরানো ঘুড়ি কাটাকাটি, হা-ডু-ডু খেলা, ধানের খড়ের গাদার ভেতর লুকানো, রীম বা টায়ার দৌড়াতাম, গাছে উঠে বাঘ হরিণ খেলাসহ আরো কত খেলা ও হাসি আনন্দ ফুর্তি আমার শৈশব কৈশোর জীবনে ছিলো তা বলে কয়ে শেষ করা যাবে না।
আমার বাবার বাড়ির অবস্থান এত সুন্দর সুখকর স্থানে যে, ইচ্ছে করলেই পূর্বে দালালবাজার, পশ্চিমে রাখালিয়া বাজার ও দক্ষিনে মুন্সিরহাট বাজার যাওয়া যায়। এর পাশাপাশি চরের দিকে চৌধুরী বাজার, রায়পুরের দিকে বাসা বাড়ি বাজার, দক্ষিনে সোজাসোজি রসুলগঞ্জ ও নবীগঞ্জ বাজার এবং লক্ষ্মীপুর তো এখন যানবাহনের কারণে কাছে এসে গেছে।
আমার শৈশব কৈশোর মানে এক স্বর্ণযুগ পেরিয়ে অন্ধকার যুগে এসেছি। আহা! তখন শৈশব-কৈশোরে টেপরেকর্ডার ও রেডিওতে গান শুনতাম। টেলিভিশন তখনও ছিল না গ্রামে। শীতের মৌসুমে গ্রামে যাত্রাপালার আয়োজন হতো। মহরম আলী বেপারী পুলের গোড়ায়, মেইলগেট, চৌধুরী বাজার, বাসা বাড়ি ও কামানখোলা নামক স্থানে প্রতিবছর যাত্রাপালার আয়োজন হতো। কখনো খোলা মাঠে, কখনো চারপাচে মুলি বাঁশের বেড়া দিয়ে টিকেট দিতো। আমি টিকেট কেটে যাত্রাপালা উপভোগ করতাম। যাত্রাপালায় কাসেম মালার প্রেম, রহিম রুপবান, সফর মুল্লুক বদিউজ্জামান ও গুনাই বিবিসহ আরো কত নাম ব্যঞ্জক নাটক মঞ্চস্থ করতো আগত যাত্রা শিল্পীরা তা শেষ নেই। আমি সেখানে সন্ধ্যার পূর্বে পৌঁছে যেতাম। স্কুলের পড়া ও বাড়ির কাজ সমাপ্ত করে সারারাত যাত্রা দেখে পরদিন সকালে আলো ফোটার পর বাড়ি ফিরে আসতাম। এমনি করে সার্কাস, হোন্ডা ও প্রাইভেটকার খেলা, পুতুল খেলা, নাগরদোলা, ঘোড়া ও হাতির পীঠে চড়া। সে কি আনন্দ করতাম তার ইয়ত্তা নেই।
প্রতি শুক্রবার সিনেমা হলে নতুন ছবি থাকতো, তা দেখতাম। কখনো যাত্রা বা সিনেমায় গেছি এ দোষে স্কুলে মার খেতে হয় নি। অন্যান্য ছাত্রদের অভিযোগ ছিল তাতে করেও আমার যথাযথ বাড়ির কাজ ও পড়া পাওয়ায় স্যারেরা আমাকে প্রহার করতে পারেননি।
হাটে বাজারে হায়দার আলী বয়াতি মানুষ জমায়েত করে লোকজ গানের আসর জমাতেন। একে অপরকে তীর্যক কথায়, হাসি ঠাট্টার ছলে জারি বা পালাগানের জমায়েত করতেন। এতে হাটে আসা মানুষেরা তাদের মোহময়ী কথার জাদুতে আকৃষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। আমিও সাথে কাউকে নিয়ে দুজনের জোট বেঁধে এরকম হাটের দিন যেতাম গান-বাজনা শোনার জন্য।
হায়দার আলীর মুখের বাম পাশে কাটা দাগ ছিল। সুঠাম ও রোদে পোড়া শ্যাম বর্ণের বিশালদেহী। ধবধবে শাদা পাঞ্জাবি লুঙ্গি পরে বিভিন্ন হাটে বাজারে আসর জমাতেন। আমি তাকে বেশিরভাগ দেখতাম রাখালিয়া বাজার ধানহাটায়, কিছু কিছু সময় দালালবাজার ও মুন্সিরহাট দেখতে পেতাম। কয়েক বছর পূর্বেও তার শিষ্যদের লক্ষ্মীপুর কোর্টের সামনে এবং স্টেশনে দেখা গেছে আসর জমাতে।
জারি- পালার ফাঁকে ফাঁকে একে অপরকে ঘায়েল করার জন্য, এতো সুন্দর হাস্যরসে ব্যঙ্গ করে কাবু করার চেষ্টা করতেন। মাঝে মাঝে তারা একে অপরকে রাগ করে নাকের শ্লেষ্মা ছুড়ে মারতেন। (আদতে তা পূর্ব থেকে হাতে রাখা কসাইদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা গরুর তৈলাক্ত চর্বি জাতীয় কিছু একটা।) ছুড়ে মারার সাথে সাথে তা গালে আষ্টেপৃষ্টে লেগে থাকতো। সেই চর্বিজাতীয় জিনিসটা যার গালে পড়তো তিনিও কমেডি স্টাইলে হাতে নিয়ে মুখ ভেংচিয়ে এত সুন্দর উপস্থাপনায় প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে সুর উঠাতেন, পালা ধরতেন, নানা রকমের শক্ত শক্ত প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতেন তাতে দর্শকরা মানে আমরা ছোট বড় সবাই হাসিতে ফেটে পড়তাম। আমরা মজা পেতাম। এই বুঝি প্রতিপক্ষ কাবু হলো!
হায়দার আলীর জারির ভক্ত এতটাই ছিলাম যে, তার সাথে কোন যন্ত্রে কে ছিলেন তা মুখস্ত হয়ে গেছিলো। হারমোনিয়ামে থাকতেন হাবিব উল্লাহ ও আবুল্লা, ঢোলে থাকতেন হেমচন্দ্র বাবু, জুড়ীতে মমিন ও হায়দার আলী বয়াতি নিজেই, বাঁশীতে সাধন বাবু। দলের প্রধান থাকতেন হায়দার আলী বয়াতি বুদ্ধিতে ও উপস্থিত পালা তৈরি করার কারণে। যেসব পালা, জারি সারি কিসসা, পু্ঁথি উপস্থিত তৈরী করে দর্শকদের মনোরঞ্জনের দিতেন তা যদি লিখে রাখতেন হায়দার আলী বয়াতি বা অন্য কেউ তা আজ বাংলা সাহিত্যে যোগ হতো দারুন সম্ভারে। আমাদের অহংকার করার মতো কিছু একটা তৈরী হতো। আহ! কি অবহেলায় হারিয়ে গেছে এসব লোকজ রত্ন ও রত্নাকর।
আমরা গভীরভাবে শোকাহত।
চলে গেলেন জারি-সারি পালাগানের কিংবদন্তি শিল্পী হায়দার আলী বয়াতি
চলে গেলেন না ফেরার দেশে জারি-সারি-পালা ও কবি গানের কিংবদন্তি সাধক হায়দার আলী বয়াতি।
১৩ শ্রাবণ ১৪২৮ বঙ্গাব্দ, ২৮ জুলাই ২০২১ খ্রীষ্টাব্দ বুধবার ভোর ৫-৩০ মিনিটের দিকে রাযপুর উপজেলার মিতালী বাজার সংলগ্ন গাইয়ার চর গ্রামের ওনার নিজ বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ইন্না-লিল্লাহ!
তিনি দীর্ঘদিন ধরে হার্ট ও কিডনি রোগে ভুগছিলেন।
মৃত্যুকালে তাঁর স্ত্রী, এক মেয়ে, তিন নাতি সহ অসংখ্য স্বজন গুনগ্রাহী ও শুভাকাঙ্ক্ষী রেখে গেছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৮৫ বছর।
এই গুণী শিল্পীর মৃত্যুতে লক্ষ্মীপুর জেলা সাহিত্য সংসদ, খেলাঘর লক্ষ্মীপুর জেলা শাখা ও অন্যতম ইতিবাচক কাগজ আবীর আকাশ জার্নাল পাঠক ফোরামের পক্ষ থেকে শোক ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়েছে।
মহান আল্লাহপাক রাব্বুল আলামিন উনাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন। শোকাহত পরিবারকে শোক সইবার শক্তি দিন।
কবিয়াল হায়দার আলী বয়াতি একজন কিংবদন্তি লোকসঙ্গীত শিল্পী। ১৯৫০’র দশক থেকে প্রায় ৫০ বছর বৃহত্তর নোয়াখালী, কুমিল্লা, সিলেট, বরিশাল ও ফরিদপুর অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি হাট-বাজার, শহর-বন্দর ও গ্রামীন জনপদে জারি গান, সারি গান; মারফতি, শরিয়তি, পীর-মুর্শিদী, আল্লাহ-নবীর (সাঃ) গুনগান এবং দেহতত্ব, সুফিতত্ব, মনঃশিক্ষা, মিলনতত্ব, রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদাবলী, পালাগান ও কবি গানের লড়াই দিয়ে হাজার হাজার ভক্ত, দর্শক-শ্রোতা ও ভাব-শিষ্যের মন জয় করেছেন। বিশেষ বিশেষ আয়োজনে দর্শক-শ্রোতাদের সারারাত মাতিয়ে রাখতেন।
কিংবদন্তি কবিয়াল কুমিল্লার হারান শীল ও ঢাকার লনী সরকার এর সাথে ঐসব অঞ্চলের জনপদে পালাগান ও কবি গানের টানা ২/৩ দিনের লড়াই করে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।★
* লেখাটিতে এমএ রহিমের ওয়াল থেকে তথ্য নেয়া হয়েছে।
লেখক কবি প্রাবন্ধিক কলামিস্ট ও সাংবাদিক।
Leave a Reply