এইবেলা ডেস্ক:: প্রবল ভূমিকম্প ঝুঁকিতে সিলেট। ৮ মাত্রায় আনতে পারে আঘত। ইন্ডিয়া প্লেট পূর্বদিকে বার্মা প্লেটের নীচে তলিয়ে যাচ্ছে আর বার্মা প্লেট পশ্চিম দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ফলে সেখানে যে পরিমাণ চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। দীর্ঘ সময় ধরে এ শক্তি জমা থাকায় হঠাৎ করে রিখটার স্কেলে ৭ থেকে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা আছে। এই দুটি প্রধান সাইমোজনিক ফল্টে অনেকদিন ভূমিকম্প না হওয়ায় সাইসমিক গ্যাপের সৃষ্টি হয়েছে। এই সাইসমিক গ্যাপ আমাদের জন্য অশনি সংকেত। এখানে সংঘটিত ভূমিকম্পে বঙ্গোপসাগরের মহীসোপানে ভূমিধস ঘটতে পারে। আর সাগরতলের ভূমিধসে সুনামি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ফলে সিলেট থেকে চট্টগ্রাম অঞ্চল ভূমিকম্পের বড় ঝুঁকিতে রয়েছে।
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দুই যুগ ধরে এ নিয়ে গবেষণা করেছে। সেখানে দেখা গেছে, ইন্ডিয়া প্লেট ও বার্মা প্লেটের সংযোগস্থলে দীর্ঘসময় ধরে কোনো ভূমিকম্পে চাপমুক্ত হয়নি। ফলে সেখানে ৪০০ থেকে হাজার বছর ধরে প্রবল চাপ জমা হয়ে রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলছেন, ‘উত্তরে তিব্বত সাব-প্লেট, ইন্ডিয়ান প্লেট এবং দক্ষিণে বার্মা সাব-প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। ফলে সিলেট-সুনামগঞ্জ হয়ে, কিশোরগঞ্জ চট্টগ্রাম হয়ে একেবারে দক্ষিণ সুমাত্রা পর্যন্ত চলে গেছে।’ তিনি বলেন, ‘এটা যেমন একবারে হতে পারে, আবার কয়েকবারেও হতে পারে। তবে যে কোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে বলে তারা আশঙ্কা করছেন। সাধারণত এ ধরনের ক্ষেত্রে সাত বা আট মাত্রার ভূমিকম্প হয়ে থাকে। কিন্তু কবে বা কখন সেটা হবে, সে ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের এখনো ধারণা নেই।’ সানফ্রানসিসকো বা দক্ষিণ আমেরিকার ভূমিকম্পের সঙ্গে এর মিল রয়েছে।
সুনামগঞ্জ, জাফলং অংশে ডাউকি ফল্টের পূর্বপ্রান্তেও ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন। এসব ফল্টে ভূমিকম্প হলে ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা বা বিপদের মাত্রা অনেক বেশি বলে তিনি আশঙ্কা করছেন।
বাংলাদেশে সর্বশেষ ১৮২২ এবং ১৯১৮ সালে মধুপুর ফল্টে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। ১৮৮৫ সালে ঢাকার কাছে মানিকগঞ্জে ৭.৫ মাত্রার একটি ভূমিকম্পের ইতিহাস রয়েছে। চুয়েট ইনস্টিটিউট অব আর্থকোয়েক ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চের পরিচালক অধ্যাপক ড. আবদুর রহমান ভূঁইয়া বলন, ভূমিকম্পের ফল্ট বা চ্যুতিরেখায় রয়েছে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার। ফলে এই অঞ্চলে প্রায়ই ছোট ছোট ভূমিকম্প হচ্ছে। এসব ভূমিকম্প বড় ভূমিকম্পের আভাস। যা ৭ থেকে ৮ মাত্রার পর্যন্ত হতে পারে। এতে ধসে যেতে পারে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের প্রায় দেড় লাখ ভবন। যার মধ্যে সিটি করপোরেশনের সেবা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, হাসপাতাল ভবন রয়েছে।
তিনি বলেন, তিনটি ফল্ট বা চ্যুতিরেখা দেশের বড় তিনটি শহরের ওপর অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এরমধ্যে শিলং মালভূমির দক্ষিণ পাদদেশে ৩০০ কি.মি. পূর্ব-পশ্চিম চ্যুতিরেখা এবং চট্টগ্রাম কক্সবাজার উপকূল বরাবর সীতাকু- টেকনাফ ফল্টে প্রচুর পরিমাণ যে স্থিতিস্থাপক শক্তি জমা আছে সেটিই দেশের ভূমিকম্পের প্রধান উৎস।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্প্রতি চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ভূমিকম্পের প্রবণতা অনেক বেড়ে গেছে। দেশে বাইরে থেকে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হওয়ার কারণে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি না হলেও বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে। এরই মধ্যে গতবছর (২০২২) ৩০ সেপ্টেম্বর ভোর ৪টা ২২ মিনিটে সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের কয়েকটি জেলায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল ৫.৫। প্রাথমিকভাবে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ভারতের মনিপুর রাজ্যের আশপাশে ধরা হয়েছে।
আর এটিই ঘটে যাওয়া সর্বশেষ বড় ভূমিকম্প। এর আগে ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্পও হয়েছে। এ সময় চট্টগ্রাম মহানগরীর অনেক ভবনে ফাটল ধরে। হেলে পড়ে অনেক ভবন। এই ভূমিকম্প যদি ৭ থেকে ৮ মাত্রায় হয় তাহলে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের প্রায় দেড় লাখ ভবন ধসে পড়তে পারে। ঘটতে পারে ব্যাপক প্রাণহানি। চট্টগ্রাম মহানগরীর চট্টগ্রামের ১ লাখ ৮৪ হাজার ভবনের মধ্যে ১ লাখ ৪২ হাজার ভবন ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে ৭৪০টি স্কুল। এমন গবেষণা তথ্য ১০ বছর আগেই দিয়েছে চট্টগ্রামের আর্থকোয়াক ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ সেন্টার। অথচ এত বছর পরও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। সংস্থাটির তথ্যমতে, দেশে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হতে পারে বাংলাদেশ-মিয়ানমার, বাংলাদেশ-ভারত এবং মিয়ানমার-ভারত সীমান্ত এলাকায়। এসব এলাকায় ৭ থেকে ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের সৃষ্টি হতে পারে। আর তা হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার।
স্থপতি ও নগর-পরিকল্পনাবিদ আশিক ইমরান বলেন, সম্প্রতি একদিনের ব্যবধানে দুইবার ভূমিকম্প অনুভূত হয় চট্টগ্রামে। এরপর ভবন হেলে পড়ার মতো ঘটনা ঘটে। তবে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি না হওয়ায় সরকারি সেবা সংস্থাগুলো এখনো উদাসীন। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম মহানগরীর ভবন ও স্থাপনার শতকরা ৯০ ভাগই নক্সা বহির্ভূতভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে নগরীর ৭৮ শতাংশ ভবনই ঝুঁকিপূর্ণ। প্রায় ১০ বছর আগের জরিপে এ চিত্র উঠে এসেছিল। যা বর্তমানে অনেকগুণ বাড়বে। কিন্তু এ নিয়ে আর কোনো জরিপ হয়নি। তিনি বলেন, দুর্যোগ ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের (সিডিএমপির) এক রিপোর্টেও বলা হয়েছে, চট্টগ্রামের ১ লাখ ৮৪ হাজার ভবনের মধ্যে ১ লাখ ৪২ হাজার ভবন ধসে পড়বে।
এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, পুরনো জরাজীর্ণ বাড়িঘর, অপরিকল্পিত ও ত্রুটিপূর্ণ নির্মাণ, নি¤œœমানের উপকরণে বহুতল ভবন, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, বান্দরবানসহ বেশকটি শহর ও শহরতলীতে নির্বিচারে পাহাড় টিলা কেটে অথবা পুকুর-দীঘি ভরাটের মাধ্যমে বাড়িঘর ও ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড-১৯৯৩ অনুসরণ করে ভূমিকম্প প্রতিরোধী নিয়ম প্রয়োগ করলে ভবন নির্মাণ খরচ মাত্র ২ থেকে ৩ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, মান্ধাতা আমলের প্রযুক্তি দিয়ে চলছে ফায়ার সার্ভিস। কোনো উঁচু ভবন বা সাধারণ বড় অগ্নিকা-ে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মতো কোনো যন্ত্র ফায়ার সার্ভিসে নেই। ভূমিকম্পের মতো বড় দুর্যোগ মোকাবিলা প্রায় অসম্ভব। ভূ-তত্ত্ববিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অবজারভেটরির সাবেক পরিচালক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, ‘পৃথিবীর ভূপৃষ্ট আলাদা আলাদা বিট বা প্লেট টেকটোনিক দিয়ে তৈরি হয়েছে, যা নিচের নরম পদার্থের ওপরে ভাসছে। সারা পৃথিবীতে এ রকম বড় সাতটি প্লেট এবং অসংখ্য ছোট ছোট সাব-প্লেট রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এগুলো যখন সরে যায় বা নড়াচড়া করতে থাকে বা একটি অন্যদিকে ধাক্কা দিতে থাকে, তখন ভূ-তত্ত্বের মাঝে ইলাস্টিক এনার্জি শক্তি সঞ্চিত হতে থাকে। সেটা যখন শিলার ধারণ ক্ষমতা পেরিয়ে যায়, তখন সেই শক্তি কোনো বিদ্যমান বা নতুন ফাটল দিয়ে বেরিয়ে আসে। তখন ভূ-পৃষ্টে কম্পন তৈরি হয়, সেটাই হচ্ছে ভূমিকম্প।’ যেসব স্থানে একটি প্লেট এসে আরেকটি প্লেটের কাছাকাছি মিশেছে বা ধাক্কা দিচ্ছে বা ফাটলের তৈরি হয়েছে, সেটাকে বলা হয় ফল্ট লাইন। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলছেন, ‘প্লেট বাউন্ডারি যেখানে তৈরি হয়েছে, সেটাকে আমরা বলি ফল্টলাইন। এর আশপাশের দেশগুলো ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে সবচেয়ে বেশি থাকে।’
Leave a Reply