সৈয়দ আমিরুজ্জামান ::::
“মনে করি আসাম যাবো
আসাম গেলে তোমায় পাবো
বাবু বলে কাম কাম, সাহেব বলে ধরে আন
আর ওই সর্দার বলে লিবো পিঠের চাম
হে যদুরাম, ফাঁকি দিয়া চলাইলি আসাম।”
-(আসামের লোকগীতি)
মুল্লুকে চলো আন্দোলন ও চা শ্রমিক গণহত্যার ১০৩ বছর পূর্ণ হয়েছে এবার। ঐতিহাসিক বীরত্বগাথা রক্তাক্ত সংগ্রামের এক মহাউপাখ্যান সৃষ্টি করেছিল চা শ্রমিকরা।
২০ মে মহান চা শ্রমিক শহীদ দিবস। ১৯২১ সালের এইদিন চাঁদপুরে মেঘনার তীরে জাহাজঘাটে শ্রমিক ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ সংঘঠিত হয়। ব্রিটিশ উপনিবেশ দ্বারা চা শিল্পের গোড়াপত্তনের সময় উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকেই চায়ের বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য বিপুল শ্রমিকের চাহিদা দেখা দেয়। কিন্তু স্থানীয় শ্রমিকদের দ্বারা শ্রমঘন এই শিল্প চালু করা সম্ভবপর নয়। তাই ব্রিটিশ সরকার ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দালালদের মাধ্যমে শ্রমিক নিয়ে আসা শুরু করে। শ্রমিক সংগ্রহের জন্য নির্দিষ্ট কমিশনপ্রাপ্ত দালালরা ‘আরকাট্টি’ নামে পরিচিত ছিল।
সমগ্র দক্ষিণ ভারত, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, বিহার, উড়িষ্যাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের নিম্নবর্ণের মানুষদের মিথ্যা আশ্বাস আর উন্নত জীবনের নিশ্চয়তা দিয়ে শ্রমিক হিসেবে নিয়ে আসা হয়। এ সকল মানুষকে প্রলুব্ধ করতে দালালরা ‘গাছ নড়লে টাকা পড়ে’ বা ‘মাটি খুড়লে সোনা পাওয়া যায়’ এ রকম নানান বানোয়াট তথ্য দিয়ে প্রলোভনে ফেলে। বিপুল শ্রমিক সংগ্রহের ব্যবস্থাকে সুসংসত করতে তৎকালীন সরকার ১৮৬৩ সালে ‘লেবার ইমিগ্রেশন অ্যাক্ট’ প্রণয়ন করে আর বিভিন্ন সময়ে সেটাকে পরিমার্জনও করে। শ্রমিকদের ধোকা দিয়ে চা শিল্প শুরুর পর থেকেই বিভিন্ন সময় শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়। দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে বিষাক্ত সাপ, হিংস্র জন্তু জানোয়ার, প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা আর মালিকশ্রেণির নির্যাতন নিত্যসঙ্গী চা শ্রমিকদের।
নামমাত্র মজুরিতে ক্রীতদাসের মতো সারাদিনের খাটুনিতে একবেলা খাবার জুটত না তাদের। অখাদ্য-কুখাদ্য, অসুখ-বিসুখ আর বন্দিদশায় অপর্যাপ্ত মজুরির পাশাপাশি বাসস্থান, খাবার, স্বাস্থ্যনিরাপত্তাসহ নানামুখী সংকটে জর্জরিত শ্রমিকরা ক্রমশই বাগানমালিক দ্বারা নিপীড়ন নির্যাতনে অতিষ্ট হয়ে ওঠে।
আসাম লেবার এনকোয়েরি কমিটির ১৯১৯-২১ সালের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৯১৭-২০ সময়কালে লক্ষাধিক চা শ্রমিক মৃত্যুবরণ করে। যাদের বেশিরভাগই অপুষ্টিজনিত ও সংক্রামক ব্যাধিতে মারা যায়। এভাবে চা বাগানে শ্রমিকদের বিদ্রোহ প্রকট আকার ধারণ করে। ভারতবর্ষজুড়ে তখন বৃটিশ বিরোধী বিপ্লবীদের তৎপরতা, খেলাফত আন্দোলন আর অসহযোগ আন্দোলনের উত্তাপের ঢেউ। মহাত্মা গান্ধী ও তাঁর অনুসারীরা তখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে জীবনবাজি রেখে।
১৯২০ সালের নানান সময়ে করিমগঞ্জ, ধলই, কাছাড় ভ্যালি, ব্রহ্মপুত্র ভ্যালি ও সিলেট ভ্যালির বিভিন্ন চা বাগানে অসন্তোষ ব্যাপক আকার ধারণ করে। যার ফলশ্রুতিতে ১৯২১ সালের মে মাসে চা শ্রমিকরা মুল্লুকে চলো বা নিজ জন্মস্থানে যাত্রার ব্যাপারে মনস্থির করে। কিন্তু নির্দয় বাগানমালিকের সাথে যোগসাজশে ব্রিটিশ সরকার রেলযোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। আর কোনো উপায় না দেখে মে মাসের ৩ তারিখ প্রায় ৩০ হাজারের বেশি চা শ্রমিক রেললাইন ধরেই চাঁদপুরের মেঘনা ঘাটের উদ্দেশে হাঁটা শুরু করে।
তৎকালীন চা শ্রমিক নেতা পণ্ডিত গঙ্গাচরণ দীক্ষিত ও পণ্ডিত দেওসরন এই ‘মুল্লুকে চল’ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। চা শ্রমিকদের কেবল ধারণা ছিল স্টিমারযোগে কলকাতা যাওয়া যায়। এদিকে ২০ মে চা শ্রমিকরা মেঘনা ঘাটে পৌঁছালে আসাম রাইফেলসের গোর্খা সৈন্য মোতায়েন করে। পরিশ্রান্ত ও সংক্ষুব্ধ চা শ্রমিকদের নিবৃত্ত করে ফেরানোর জন্য তৎকালীন অ্যাসিস্ট্যান্ট ডেপুটি কমিশনার মিস্টার কে সি দের নির্দেশ ও তত্ত্বাবধানে গোর্খা সৈন্যরা গুলিবর্ষণ শুরু করে। অসহায় চা শ্রমিকের রক্তে লাল হয় মেঘনা নদীর জল। চা বাগানের ব্রিটিশ মালিক এবং তাদের দোসরদের গুলিতে এ দিন প্রাণ হারান কয়েকশ চা শ্রমিক। কারও কারও মতে এই সংখ্যা কয়েক হাজার। অজস্র মৃতদেহ ভেসে যায় মেঘনার বুকে। যার মাধ্যমে সংঘটিত হয় ইতিহাসের নির্মমতম শ্রমিক হত্যাযজ্ঞ।
এই বর্বরোচিত হত্যার পর স্টিমার শ্রমিক, রেলশ্রমিক এবং পুরো আসাম ও পূর্ব বাংলার চা শ্রমিকরা একযোগে ধর্মঘট শুরু করে শ্রমিক হত্যার প্রতিবাদ অব্যাহত রাখেন। মহাত্মা গান্ধী, মাওলানা মোহাম্মদ আলী, চিত্তরঞ্জন দাস, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর মতো নেতারা ছুটে আসেন চাঁদপুর।
চাঁদপুরে চা শ্রমিকদের এই আত্মত্যাগের মধ্য দিয়েই ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ত্বরান্বিত হয়। আর ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের ভিত রচিত হয়। চা বাগানের প্রেক্ষাপটে মূলকরাজ আনন্দের ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত চাঞ্চল্যকর উপন্যাস ‘টু বাডস অ্যান্ড এ লিফ’ এ বাগান মালিকদের অমানবিক অত্যাচারের চিত্র পরিস্ফূটিত হয়েছে।
তবে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে চা শিল্প হলো উপনিবেশবাদের ফলাফল। একে বরাবরই টি এস্টেট বলা হয়েছে। কাজেই বাগানমালিকরা ঔপনিবেশিক শাসকের ন্যায় শোষণ-নিপীড়ন অব্যাহত রেখে চলেছে এবং ঐতিহাসিকভাবেই মালিকপক্ষ রাষ্ট্রের সাথে অনেক নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। স্বাধীনতার পূর্ব ও পরবর্তী উভয় সময়েই মালিকপক্ষ রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদতে চা শ্রমিকদের মজুরি সবচেয়ে কম রাখার প্রচেষ্টা করেই চলেছে। ফলত চা মালিকরা শুরু থেকেই চা বাগানে এমন পরিকাঠামো গড়ে তুলেছে যা হলো রাষ্ট্রের ভিতরে আরেক রাষ্ট্র। সভ্যতার বাইরে এক আলাদা জগৎ। অট্টালিকা গড়ে তুলবার এক অন্ধকারচ্ছন্ন দ্বীপ। তাদের শ্রমে বিত্ত বৈভব গড়ে উঠলেও, এদেরকে বঞ্চিত করা হয়েছে বরাবরই। এদের শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হলে, হয়তো আপত্তির কিছু থাকতো না।
সাম্প্রতিক সময়েও কালিটি চা বাগানের বকেয়া মজুরির আন্দোলন কিংবা রেমা চা বাগানের বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাগানমালিকদের আচরণে এটা আরও পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান হয়েছে।
যে অধিকার রক্ষার জন্য চা শ্রমিকদের ঐতিহাসিক আত্মত্যাগের দুঃখগাথা রচিত হয়েছে তার বাস্তবায়ন এই ১০৩ বছরেও হয়নি। বছরের পর বছর বাগানমালিক ও সরকারের শোষণ-নিপীড়নের স্বীকার হচ্ছে চা শ্রমিকরা। নামমাত্র মজুরির পাশাপাশি ন্যূনতম মৌলিক অধিকার বরাবরই অধরাই থেকেছে। চা শ্রমিকদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়, এমন মজুরি চাই। মুনাফা ও সম্পদের ৯০% মালিকানা শ্রমিকদের হওয়া উচিত।
তাই বলা যায় চা শ্রমিকদের অধিকার আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ভোগবাদী সমাজব্যবস্থার পুঁজিবাদী মনোভাব চা শ্রমিকদের জীবন চা গাছের ন্যায় বনসাই করে রেখেছে। চা শ্রমিকদের অমানবিক পরিশ্রমে ক্রমান্বয়ে চা শিল্পের বিকাশ ঘটেছে যার দরুন চা উৎপাদনের নতুন রেকর্ড গড়ে জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য অবদানের পাশাপাশি রফতানিমুখী শিল্প হিসেবে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে কিন্তু দুষ্টচক্রে বাধা চা শ্রমিকদের জীবন মানের উন্নয়ন আর হয় না।
শ্রম আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে চা জনগোষ্ঠীকে বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ও শিক্ষার অধিকার থেকে দূরে রেখেই বাগান পরিচালনা করছে মালিক পক্ষ। সরকারের এ ব্যাপারে তো কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। এতেই বোঝা যায় মুনাফালোভী বাগানমালিক আর রাষ্ট্রব্যবস্থা একে অপরের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। ১০২ বছর পরও চা শ্রমিকদের মুল্লুকে চলো আন্দোলনের আবেদন বারবার তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে ফিরে ফিরে আসে। চুক্তির মাধ্যমে চা শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরিব্যবস্থা চালু করা যায়নি। অদ্যাবধি আইনগতভাবে ন্যূনতম মজুরি বোর্ড দ্বারা শ্রমমূল্যের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। ফলে চা শ্রমিকদের শ্রমের বিনিময়ে ন্যায্য মজুরির নিশ্চয়তা এই রাষ্ট্র নির্ধারণ করে দিতে পারেনি।
আর চা শ্রমিকদের ভূমির অধিকার না থাকায় বাগানমালিকরা একুশ শতকেও জমিদার হিসেবেই রয়ে গেছে। হাজার হাজার চা শ্রমিকের বলিদানের পর আজ তার একশত তিনবর্ষেও এই রাষ্ট্র তাদের জীবনের মর্যাদা দেয়নি। গণহত্যার এই দিনটিকে মহান চা শ্রমিক শহীদ দিবস হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই। শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় মহান চা শ্রমিক শহীদ দিবস চিরভাস্বর হয়ে থাকুক। চা শ্রমিক শহীদ দিবসের সংগ্রামের চেতনায় বারবার অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে চা শ্রমিকরা পুনর্জীবিত আর উদ্দীপ্ত হোক এই প্রত্যাশা রাখি।
#
সৈয়দ আমিরুজ্জামান
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট;
বিশেষ প্রতিনিধি, সাপ্তাহিক নতুনকথা;
সম্পাদক, আরপি নিউজ;
কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, জাতীয় কৃষক সমিতি;
সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, মৌলভীবাজার জেলা;
‘৯০-এর মহান গণঅভ্যুত্থানের সংগঠক ও সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রী।
সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ খেতমজুর ইউনিয়ন।
সাধারণ সম্পাদক, মাগুরছড়ার গ্যাস সম্পদ ও পরিবেশ ধ্বংসের ক্ষতিপূরণ আদায় জাতীয় কমিটি।
প্রাক্তন সভাপতি, বাংলাদেশ আইন ছাত্র ফেডারেশন।
WhatsApp : 01716599589
মুঠোফোন: ০১৭১৬৫৯৯৫৮৯
Leave a Reply