এবে ডেস্ক :: সিলেটের জন্য অভিশাপস্বরূপ নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনায় রূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে বন্যা। এক মাসের ব্যবধানে তৃতীয় দফা বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে সিলেট। টানা বৃষ্টি ও উজানের ঢলে সিলেটে চলমান তৃতীয় দফা বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।
ফের বাড়ছে নদ-নদীর পানি। ২০২২ সালে সিলেটে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল। এবারের বন্যা দুই বছর আগের সেই স্মৃতি মনে করিয়ে দিচ্ছে সিলেটবাসীকে। আকস্মিক এ বন্যায় জেলা জুড়ে ৭ লাখ ১১ হাজার ২২৬ জন মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন। পানিবন্দিদের সেবা দিতে ১২৬টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে।
সোমবার (০১ জুলাই) রাত থেকেই নগরীর বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এ ছাড়া গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর, কানাইঘাটসহ সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলোয় পানি বেড়ে বন্যা পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে। সোমবার দিন ও রাতভর সিলেটে বৃষ্টি হয়েছে। ফলে নদ-নদীর পানি বেড়ে ও নতুন করে আরও এলাকা প্লাবিত হয়ে সিলেটে চলমান বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। নতুন করে প্লাবিত বাড়িঘরের মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটে যাচ্ছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন বাজার তলিয়ে পানি ঢুকেছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। এতে নতুন করে ক্ষতিতে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা।
টানা বৃষ্টিতে জনদুর্ভোগ বেড়েছে। বিশেষ করে মঙ্গলবার সকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অফিসমুখী লোকজন যানবাহনের স্বল্পতায় কাক ভেজা হয়ে গন্তব্যে পৌঁছেছেন। ইতোমধ্যে সিলেট নগরীতে থাকা ৯টি ছড়া উপচে পানি প্রবেশ করছে অফিস ও বাসাবাড়িতে। নগরবাসী আবারো সীমাহীন ভোগান্তির মধ্যে পড়েছে।
দুপুরে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানায়, সিলেটের ১৩টি উপজেলায় ৭ লাখ ১১ হাজার ২২৬ জন মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন। ৬৫৩টি আশ্রয়কেন্দ্রের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছেন ৮ হাজার ৩০৮ জন। ১৩টি উপজেলায় ১১৮৪ টি গ্রাম বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কোম্পানীগঞ্জ, কানাইঘাট ,জকিগঞ্জ। বন্যার্ত মানুষের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। ১২৬টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া জেলা প্রশাসন ও প্রত্যেক উপজেলা প্রশাসন কার্যালয়ে কন্ট্রোল স্থাপন করে বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। প্রতি ইউনিয়নে মেডিকেল টিম গঠন করে বন্যার্ত অসুস্থ মানুষকে দেওয়া হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা।
সরেজমিনে দেখা যায়, নগরের বেশ কিছু এলাকার সড়ক ও বাসাবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। এর মধ্যে নগরের মির্জাজাঙ্গাল, মণিপুরি রাজবাড়ি, তালতলা, জামতলা, কুয়ারপা শিবগঞ্জ, শাহজালাল উপশহর, হাওয়াপাড়া, যতরপুর, মেন্দিবাগ, তোপখানা, মজুমদারি, চৌকিদেখী, দক্ষিণ সুরমাসহ বেশ কিছু এলাকায় জলাবদ্ধ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন নগরের বাসিন্দারা।
মঙ্গলবার (২ জুলাই) সকাল ৯টায় সিলেটে ৫টি নদীর পানি ৬টি স্থানে বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এ ছাড়া সকাল পর্যন্ত ২৭ ঘণ্টায় সিলেটে ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।
পাউবো আরও সূত্র জানায়, সকাল ৯টায় সিলেটের ৫টি নদীর পানি ৬ পয়েন্টে বিপৎসীমার উপরে ছিল। এর মধ্যে সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে ১১৮ সেমি, কুশিয়ারার পানি আমলশীদ পয়েন্টে ৭১ সেমি, এ নদীর ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে পানি ২২ সেমি ও কুশিয়ারা পয়েন্টে ০.৭ এবং সারিগোয়াইন নদীর পানি গোয়াইনঘাট পয়েন্টে ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এ ছাড়া কুশিয়ারা নদীর অমলশিদ, শেওলা, শেরপুর ও ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। সারী নদীর পানি গোয়াইনঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে।
উপশহরের বাসিন্দা কাজী জুবায়ের বলেন, উপশহরে কিছু হলেই পানি উঠে যায়। বাসাবাড়ির নিচতলায় থাকা যাচ্ছে না। এর জন্য দ্রুত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
তিনি বলেন, উপশহরে প্রধান সড়ক পর্যন্ত পানিতে তলিয়েছে। বাসাবাড়ির অবস্থা খারাপ।
পাউবো সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ভারি বৃষ্টিপাত সিলেটের জন্য শঙ্কার। চেরাপুঞ্জিতে সোমবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত গত ৪৮ ঘণ্টায় ৫০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের খবর পাওয়া গেছে। সেখানে আরও বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া সিলেটেও ভারি বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে।
তিনি বলেন, ভারতের পাহাড়ি ঢলের কারণে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পায়। এর আগে দুই দফা পাহাড়ি ঢল এবং সিলেটে ভারী বৃষ্টির কারণে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। কয় দিন বৃষ্টি না থাকায় পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যাচ্ছিল। এখন আবার বন্যা পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে।
সিলেট আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজিব হোসাইন বলেছেন, মঙ্গলবারও টানা বৃষ্টি হচ্ছে সিলেটে। সকাল ৬টা পর্যন্ত ২৯৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।
সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজ বলেন, সুরমা তীরবর্তী ১২টি ওয়ার্ডে পানি উঠে গেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বন্যা পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাচ্ছে। আমরাও প্রস্তুত আছি এই দুর্যোগ মোকাবেলায়, আশ্রয়কেন্দ্র ও ত্রাণ প্রস্তুত করা হচ্ছে।
সিলেটের ডেপুটি সিভিল সার্জন জন্মজয় দত্ত বলেন, পানি মানুষদের সেবা দিতে আমাদের ১২৬টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। পানিবাহিত রোগ থেকে বাচার জন্য সবাইকে পানি বিশুদ্ধতাকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট আমরা বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছি। আমাদের ইউনিয়নভিত্তিক টিমও কাজ করছে।
সিলেটে এর আগে গত ২৮ মে থেকে ভারি বৃষ্টির ফলে প্রথম দফায় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। প্রথম বন্যার পানি পুরোপুরি নামার আগেই পরে গত ১৬ জুন আবার বন্যা পরিস্থিতিতে দুর্ভোগে পড়েন সিলেটের বাসিন্দারা। বিশেষ ঈদুল আজহার দিন ভোররাত থেকে মাত্র কয়েক ঘণ্টার অতি ভারি বর্ষণে মহানগরসহ সিলেটের সব উপজেলায় লাখ লাখ মানুষ হয়ে পড়েন। পরবর্তী এক সপ্তাহ সিলেটে বন্যা পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ। এরপর পানি নামতে শুরু করে। তবে সে গতি ছিল খুব ধীর।
Leave a Reply