হাছন রাজার জীবন কথা : বিলাসী জমিদার থেকে দরবেশ বাউলের যাত্রা! – এইবেলা
  1. admin@eibela.net : admin :
শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:১৫ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথ পুনর্বাসন প্রকল্প পরিদর্শনে রেলওয়ে সচিব- সম্পন্নের ডেডলাইনেও বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় বড়লেখায় খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনায় নফল রোজা শেষে ইফতার ও দোয়া মাহফিল কুলাউড়ায় আদালতের নির্দেশনা ভঙ্গ করে কৃষকদের জমিতে ফসল রোপণের অভিযোগ ছাতকের ইউএনও’কে বিদায় সংবর্ধনা প্রদান ফুলবাড়ীতে বিজিবি’র অভিযানে মাদকদ্রব্য ও ভারতীয় শাড়ি উদ্ধার সহকারি শিক্ষকদের সাটডাউন- বড়লেখায় কক্ষের তালা ভেঙ্গে পরীক্ষা নেওয়ালেন অভিভাবকরা কুলাউড়ার মুরইছড়া  সীমান্তে  ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বিএসএফের গুলিতে  যুবক নিহত কুলাউড়ায় নাগরিক সমন্বয় প্রকল্পের বার্ষিক টাউন হল মিটিং কর্মক্ষেত্রের চাহিদা অনুযায়ী নিজেকে গড়ে তুলতে হবে- ইউএনও মহিউদ্দিন বড়লেখায় প্রধান শিক্ষককে ছুরিকাঘাতে হত্যার চেষ্টা প্রাক্তন ছাত্র গ্রেফতার

হাছন রাজার জীবন কথা : বিলাসী জমিদার থেকে দরবেশ বাউলের যাত্রা!

  • মঙ্গলবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

Manual2 Ad Code

আনোয়ার হোসেন র‌নি ::

হাছন রাজার জীবন এক অনন্য দৃষ্টান্ত। বিলাসী জমিদার থেকে দরবেশ বাউল হয়ে ওঠার যাত্রা একদিকে যেমন নাটকীয়, অন্যদিকে তেমনি গভীর শিক্ষামূলক। তাঁর গান আজও বাজে গ্রামের মেলায়, শহরের কনসার্টে, মানুষের অন্তরে। তিনি প্রমাণ করে গেছেন—ভুল করেও মানুষ নিজেকে বদলাতে পারে, ঈশ্বর আর মানবপ্রেমে শুদ্ধ হতে পারে। হাছন রাজা তাই শুধু একজন জমিদার বা গীতিকার নন—তিনি বাংলার লোকজ সংস্কৃতির অবিনশ্বর এক আলোকবর্তিকা।

Manual4 Ad Code

বাংলার ইতিহাসে এক রহস্যময় নাম হাছন রাজা। তিনি ছিলেন একাধারে জমিদার, ভোগবিলাসী যুবরাজ, আবার রূপান্তরিত হয়ে হয়েছেন আধ্যাত্মিক বাউল সাধক। তাঁর জীবন যেন এক নাটকীয় রূপকথা—যেখানে আছে আভিজাত্য, প্রেম, পতন, আত্মসমালোচনা আর পুনর্জন্ম। ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, হাছন রাজার জীবনকথা কেবল একটি মানুষের গল্প নয়; বরং এটি এক সামাজিক পরিবর্তনের দলিল, এক সাংস্কৃতিক জাগরণের আখ্যান।

জমিদারি উত্তরাধিকার ও বিলাসিতার শুরু

বড় ভাই ও বাবার মৃত্যুর পর অল্প বয়সেই প্রায় ৬ লাখ বিঘা জমির বিশাল এলাকার জমিদারির দায়িত্ব এসে পড়ে হাছন রাজার কাঁধে। এতো অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়ে তিনি খুব দ্রুত ভোগবিলাসে মত্ত হয়ে পড়েন। কচি বয়স, অপরিসীম ঐশ্বর্য আর অসীম ক্ষমতার কারণে তিনি হয়ে ওঠেন বাংলার অন্যতম বিলাসী জমিদার। নারীর প্রতি তাঁর ছিল প্রবল আকর্ষণ। তিনি নিজেই পরে স্বীকার করেছিলেন—
“সর্বলোকে বলে হাছন রাজা লম্পটিয়া।”

Manual2 Ad Code

এই লম্পটতার আড়ালে লুকিয়ে ছিল এক সংবেদনশীল মন, যে সবসময় প্রেম খুঁজেছে, সৌন্দর্যের পূজা করেছে।

Manual6 Ad Code

দিলারামের প্রেম ও মায়ের হস্তক্ষেপ হাছন রাজার জীবনে প্রেম এসেছিল বহুবার। তবে প্রথম বড় আলোড়ন তোলেন দিলারাম নামের এক হিন্দু যুবতী। তাঁর রূপে মোহিত হয়ে হাছন রাজা নিজের গলার সোনার চেইন উপহার দেন। সুদর্শন জমিদারের অমূল্য উপহার পেয়ে দিলারামও তাঁকে হৃদয়ের পূজার আসনে বসালেন। প্রেমে মজে হাছন রাজা লিখলেন—
“ধর দিলারাম, ধর দিলারাম, ধর দিলারাম, ধর।
হাছন রাজারে বান্ধিয়া রাখ, দিলারাম তোর ঘর!”
কিন্তু জমিদার পরিবারের আভিজাত্য মানসিকতায় এই সম্পর্ক মেনে নেননি হাছনের মা। পারিবারিক বংশগৌরবের কথা ভেবে তিনি দিলারামকে গ্রামছাড়া করেন।

এ সিদ্ধান্ত তরুণ হাছনের মনে তৈরি করে এক গভীর ক্ষোভ। প্রিয়তমাকে হারিয়ে তিনি নারী আসক্তি ও নেশায় আরও ডুবে যান।
বাইজি-প্রীতি ও বিলাসী নৌকাবিহার
দিলারামকে হারানোর পর হাছন রাজার জীবন ভেসে যায় বাইজি আর মদে। প্রতি বর্ষায় বিশাল নৌকার বহর নিয়ে তিনি বের হতেন হাওরে। সেখানে থাকতো নাচ-গানের আয়োজন, বাইজিদের আসর, মদের আসর।
এই সময় তিনি পরিচিত হন লখনৌ থেকে আসা সুন্দরী বাইজি পিয়ারির সঙ্গে। তাঁর রূপে বিমোহিত হয়ে হাছন রাজা লিখে ফেলেন—
“নেশা লাগিল রে। বাঁকা দুই নয়নে নেশা লাগিল রে।নহাছন রাজা পিয়ারির প্রেমে মজিলোরে…”
প্রজাদের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব ক্রমেই বেড়ে যায়। অত্যাচারী, নিষ্ঠুর জমিদার হিসেবেই তাঁকে চিনতে শুরু করে সাধারণ মানুষ। মায়ের ছদ্মবেশ ও ছেলের চোখে আঘাত ছেলেকে বিপথে যেতে দেখে হাছন রাজার মা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। একদিন তিনি বাইজির ছদ্মবেশে গিয়ে ছেলের জলসা ঘরে উপস্থিত হন। মাকে চিনে ফেলেই হাছন রাজা মায়ের পায়ে লুটিয়ে পড়েন।
এ ঘটনা তাঁকে লজ্জিত করে তোলে। মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা আর নিজের অন্তর্দ্বন্দ্ব তাঁকে নারী-আসক্তি ও নেশার পথ থেকে কিছুটা ফিরিয়ে আনে।
আধ্যাত্মিক রূপান্তর কিন্তু আসল পরিবর্তন আসে এক রহস্যময় স্বপ্ন-দর্শনের পর। সেই অভিজ্ঞতা তাঁকে আধ্যাত্মিক জগতে টেনে নেয়। জমকালো পোশাক, দামি অলঙ্কার, বিলাসী ভোগ—সব ছেড়ে হাছন রাজা হয়ে ওঠেন সাধারণ। তিনি প্রজাদের খোঁজ নিতে শুরু করেন, দরিদ্রদের পাশে দাঁড়ান। ভোগবিলাসী জমিদার থেকে তিনি রূপান্তরিত হন এক বাউল-দরবেশে।

হাছন রাজার গান: বাউল ভাবধারার উন্মেষ-

ভুল-ত্রুটির স্মৃতি, অনুতাপ আর ঈশ্বরপ্রেম তাঁর গানে ফুটে ওঠে। তিনি লিখলেন—
“লোকে বলে বলেরে, ঘর বাড়ি ভালা নায় আমার।”
“কানাই তুমি খেল খেলাও কেনে।”
“মাটিরো পিঞ্জিরার মাঝে বন্ধী হইয়া রে।”
“বাউলা কে বানাইলো রে।”
“আগুন লাগাইয়া দিলো কনে।”
“সোনা বন্দে আমারে দেওয়ানা বাইনালে।”
তাঁর গানে জীবনের অস্থায়িত্ব, ভোগের শূন্যতা আর আধ্যাত্মিক প্রেমের জয়গান উঠে আসে। অতীতের পাপ ও ভুলকে স্বীকার করে তিনি লেখেন—
“একদিন তোর হইবোরে মরণ।”
বৈরাগ্য ও দরবেশ জীবন
ধীরে ধীরে হাছন রাজাকে পেয়ে বসে গভীর বৈরাগ্য। তিনি সম্পত্তির প্রতি আসক্তি ছেড়ে দিয়ে জমিদারির বিশাল অংশ প্রজাদের মধ্যে বিলি-বণ্টন করেন। নিজে বেছে নেন উদাসীন বাউল জীবন। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন হাছন এম. ই. হাই স্কুল, অসংখ্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও আখড়া। এভাবে তিনি সমাজসেবায়ও হয়ে ওঠেন এক অগ্রদূত।

সুদর্শন জমিদার: নারীদের আকর্ষণ
হাছন রাজার দৈহিক সৌন্দর্যের কথাও সর্বত্র প্রচলিত ছিল। তিনি ছিলেন লম্বা দেহী, খাড়া সূচালো নাক, জ্যোতির্ময় পিঙ্গলা চোখ আর ঘন চুলের অধিকারী। এ কারণে বহু নারী তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হতেন। তবে জীবনের শেষভাগে তিনি নারীর মোহ থেকে বেরিয়ে গিয়ে একেবারে আধ্যাত্মিক প্রেমে ডুবে থাকেন।

Manual8 Ad Code

উত্তরাধিকার ও সাংস্কৃতিক প্রভাব  হাছন রাজার জীবনকথা আমাদের শেখায়—অঢেল সম্পদ, আভিজাত্য ও বিলাসিতা কোনো মানুষকে পূর্ণতা দিতে পারে না। পূর্ণতা আসে আত্ম-উপলব্ধি ও মানবিকতায়। বাংলার লোকসংগীত, বিশেষ করে বাউল ধারার সঙ্গে হাছন রাজার গান মিশে আছে আজও। তাঁর গান কেবল আধ্যাত্মিক উপলব্ধির দিশা দেয় না, বরং মানুষের ভেতরের অপূর্ণতাকে মমতায় জড়িয়ে ধরে।##!

লেখকঃ সাংবা‌দিক, ক‌বি, সাধারণ সম্পাদক ছাতক প্রেসক্লাব, কাব‌্যকথা সা‌হিত‌্য প‌রিষ‌দের বিভাগীয় সাংগঠ‌নিক সম্পাদক।

মোবাইল নম্বারঃ ০১৭১১৪৪৭৬৮৬

সংবাদটি শেয়ার করুন


Deprecated: File Theme without comments.php is deprecated since version 3.0.0 with no alternative available. Please include a comments.php template in your theme. in /home/eibela12/public_html/wp-includes/functions.php on line 6121

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো সংবাদ পড়ুন
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০২২ - ২০২৪
Theme Customized By BreakingNews

Follow for More!