মোঃ বুলবুল ইসলাম, কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি ::
তফসিল ঘোষণার আগেই কুড়িগ্রামের চারটি সংসদীয় আসনে নির্বাচনি প্রচারণা জমে উঠেছে। প্রতিদিন ভোটারদের কাছে যাচ্ছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলনসহ নির্বাচনমুখী দলগুলো। আওয়ামী লীগবিহীন ভোটের মাঠে বিএনপিতে স্বস্তি থাকার কথা থাকলেও জামায়াতে ইসলামীসহ ‘আটদলীয় জোট’ এবং জাতীয় পার্টিকে (জাপা) নিয়ে বেশ অস্বস্তিতে রয়েছেন দলটির নেতাকর্মীরা।
গত তিনটি সংসদ নির্বাচনে আসনগুলো আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির দখলে থাকলেও এবার সেগুলো নিয়ন্ত্রণে নিতে চায় বিএনপি ও জামায়াত। যদিও জাপার নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিয়ে ধোঁয়াশা রয়ে গেছে।
দলগুলোর কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নির্বাচন নিয়ে নানা বিতর্ক চললেও মাঠপর্যায়ে নেতাকর্মীরা প্রচারণায় নেমে পড়েছেন। প্রতীক ও মনোনীত প্রার্থীদের ছবি সংবলিত পোস্টার, ব্যানার ও ফ্যাস্টুনে ছেয়ে গেছে নির্বাচনি এলাকাগুলো। চলছে মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা। সড়কের বিভিন্ন স্থানে তোরণও তৈরি করা হয়েছে। শুরু হয়েছে বিভিন্ন দলের ভোট সংখ্যা নিয়ে হিসাব-নিকাশ।
কুড়িগ্রাম-২ আসনে (সদর, রাজারহাট ও ফুলবাড়ী) বিএনপি প্রার্থী ও জেলা বিএনপির সদস্যসচিব সোহেল হোসনাইন কায়কোবাদের শক্ত অবস্থান প্রতীয়মান হলেও অপর তিনটি আসনে জামায়াতে ইসলামীসহ ‘আটদলীয় জোট’ এবং জাতীয় পার্টির ভোটের সমীকরণ নিয়ে অস্বস্তিতে রয়েছে বিএনপি। দলগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী এবং স্থানীয় ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
গত তিনটি নির্বাচনের ফল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দশম জাতীয় সংসদ (২০১৪) নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী হিসেবে ছাড় দেওয়ায় কুড়িগ্রামের চারটি আসনের তিনটিতে জাতীয় পার্টি (এরশাদ) এবং একটিতে জাতীয় পার্টি (মঞ্জু) মনোনীত প্রার্থী বিজয়ী হন। এরপর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জাপার ‘দুর্গ’ ভেঙে পড়ে। একাদশ সংসদ নির্বাচনে একটি আসন জাপাকে (এরশাদ) ছেড়ে দিয়ে বাকি তিনটিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা বিজয়ী হন। বিএনপি ও জামায়াতবিহীন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দুটিতে বিজয় লাভ করলেও কুড়িগ্রাম-২ আসনে জোটসঙ্গী জাপাকে হারিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও কুড়িগ্রাম-১ আসনে আওয়ামী লীগকে হারিয়ে জাপা (এরশাদ) প্রার্থী বিজয়ী হন।
কুড়িগ্রাম-১ আসনে ত্রিমুখী লড়াইয়ের আভাসঃ
কুড়িগ্রাম-১ আসনে (নাগেশ্বরী ও ভূরুঙ্গামারী) লড়াই হতে পারে ত্রিমুখী। এখানে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এমপি সাইফুর রহমান রানা। তার ভোট ব্যাংক থাকলেও দলীয় কোন্দল আর জাপার সম্ভাব্য প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাকের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আভাস বিএনপির জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাঁচবারের সংসদ সদস্য এই জাপা নেতা নির্বাচনে অংশ নিলে নিজস্ব ভোট ব্যাংক ছাড়াও আওয়ামী লীগের ভোট টানতে পারেন বলে আশঙ্কা করছে বিএনপির একটি অংশ। এ ছাড়া ‘আটদলীয় জোট’ ভোটের সমীকরণ পাল্টে দিতে পারে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় ভোটাররা। জামায়াত থেকে প্রার্থী হয়েছেন আনোয়ারুল ইসলাম এবং ইসলামী আন্দোলন থেকে মনোনীত হয়েছেন হারিসুল বারি রনি। জাপা নির্বাচনে অংশ না নিলে আওয়ামী লীগ ও জাপার ভোট এই আসনে তুরুপের তাস হয়ে দাঁড়াবে। এই দুই দলের সমর্থককের ভোট কোন দলের দিকে ঝুঁকবে, তা নিয়ে চলছে হিসাব-নিকাশ।
ভোটের মাঠের চিত্র সম্পর্কে জানতে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী সাইফুর রহমান রানার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে জাপার সম্ভাব্য প্রার্থী ও সাবেক এমপি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত যদি নির্বাচনে অংশ নিই তাহলে শুধু এই আসন নয়, বৃহত্তর রংপুরে আমাদের বিজয় ঠেকিয়ে দেওয়ার মতো দল নেই।’
কুড়িগ্রাম-২ আসনে স্বস্তিতে বিএনপিঃ
বেশিরভাগ সময় জাপার দখলে থাকা এই আসন গত নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর হাতে গেলেও এবার তা নিতে চায় বিএনপি ও জামায়াত। তবে জেলার চারটি আসনের মধ্যে এটিতে বিএনপি অনেকটা স্বস্তিতে রয়েছে। কিন্তু জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন ছাড় দিতে নারাজ। তারাও জোর প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে আসনটি বিএনপির জোটসঙ্গীর চাহিদার বলি হতে পারে বলে সংশয় প্রকাশ করছেন অনেকে।
আসনটিতে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী সোহেল হোসনাইন কায়কোবাদ। তিনি দলীয় নেতাকর্মীদের পাশাপাশি স্থানীয় ভোটারদের মাঝেও বেশ জনপ্রিয়। এমনকি আওয়ামী লীগ সমর্থকদের মধ্যেও গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। এখানে জাপা প্রার্থী হিসেবে সাবেক এমপি পনির উদ্দিন আহমেদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার আলোচনা থাকলেও বিএনপি প্রার্থীর মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারেন জামায়াত মনোনীত প্রার্থী অ্যাডভোকেট ইয়াসিন আলী সরকার। নারী শাখাসহ জামায়াত নেতাকর্মীদের নিয়মিত জনসংযোগ ভোটারদের মধ্যে আলোচনার সৃষ্টি করেছে। সম্ভাব্য ইসলামী জোট থেকে একক প্রার্থী হলে এখানেও ভোটের লড়াই জমে উঠতে পারে। এখানে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী অধ্যক্ষ মাওলানা মো. নূর বখত মিয়া এবং এনসিপির প্রার্থী ড. আতিক মুজাহিদ। তারাও নিয়মিত জনসংযোগ করছেন। শেষ পর্যন্ত জাপা নির্বাচনে না গেলে এই আসনে জাপা ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের ভোট বিভিন্ন প্রার্থীর মধ্যে ভাগ হয়ে যেতে পারে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় ভোটাররা।
কুড়িগ্রাম-৩ আসনে জটিল সমীকরণের মধ্যে বিএনপিঃ
একটি মাত্র উপজেলা (উলিপুর) নিয়ে গঠিত এই আসনে জটিল সমীকরণের মধ্যে পড়েছে বিএনপি। দলীয় বিভক্তির সঙ্গে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের দুই হেভিওয়েট প্রার্থী বিএনপিকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। ‘আটদলীয় জোট’ বিএনপি প্রার্থীর অস্বস্তি বাড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে করছেন ভোটার ও স্থানীয় নেতাকর্মীরা।
ভোটার ও রাজনীতি সচেতনরা বলছেন, বিএনপির পর্যাপ্ত ভোট থাকলেও দলীয় বিভক্তি কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে। বিএনপি প্রার্থী সাবেক জেলা সভাপতি তাসভীর উল ইসলাম গ্রুপ এবং মনোনয়নবঞ্চিত রংপুর বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল খালেক গ্রুপের দ্বন্দ্ব ভোটের মাঠে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। খালেক গ্রুপের সমর্থকরা প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন। এ ছাড়া তাসভীর উল ইসলাম ভোটারদের সঙ্গে অনেকটা দূরত্ব বজায় রেখে জনসংযোগ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
আসনটিতে বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াতের সাবেক ছাত্রনেতা ব্যারিস্টার মাহবুবুল আলম সালেহী এবং ইসলামী আন্দোলন নেতা সাবেক সংসদ সদস্য ডা. আক্কাছ আলী সরকার। এ ছাড়া গণঅধিকার পরিষদের নেতা নুরে এরশাদ সিদ্দিকী এবং জাপার সম্ভাব্য প্রার্থী আব্দুস সোবহানও ভোটারদের আলোচনায় আছেন।
অপরদিকে আসনটিতে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের ভোটের একটি বড় অংশ জাপা ও ইসলামী আন্দোলন প্রার্থীর ব্যক্তিগত ভোট ব্যাংক হিসেবে কাজ করতে পারে। ‘আটদলীয় জোট’ থেকে একক প্রার্থী দিলে আসনটিতে বিজয়ী হওয়া বিএনপির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
কুড়িগ্রাম-৪ আসনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাসঃ
চিলমারী, রৌমারী ও চর রাজিবপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত এই আসনে বিএনপি এবং জামায়াত থেকে প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হয়েছেন আপন দুই ভাই। লড়াইটা তাই দলের পাশাপাশি দুই ভাইয়েরও। ফলে জামায়াত-বিএনপির হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। কয়েক মাস আগে জামায়াত থেকে প্রার্থী হন মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাক। পরে বিএনপি থেকে তারই বড় ভাই রৌমারী উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আজিজুর রহমানকে প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করা হয়। ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী হাফিজুর রহমানও একই গ্রামের বাসিন্দা। তিনিও জনসংযোগ করছেন। জাপার সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে রৌমারীর সাইফুর রহমানের নাম শোনা গেলেও এখন পর্যন্ত জনসংযোগ করতে দেখা যায়নি। ফলে জাপা নিয়ে ভোটারদের মধ্যে তেমন আলোচনাও নেই।
জামায়াত প্রার্থীর পরিবার থেকে বিএনপি প্রার্থীকে মনোনীত করায় দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভক্তি দেখা দিয়েছে। এখানের বাসিন্দা মহিলা দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক মমতাজ হোসেন লিপির সমর্থকরা প্রার্থী পরিবর্তনের জন্য বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করছেন। বিএনপির বিভক্তি জামায়াতকে লাভবান করছে বলে মনে করছেন ভোটাররা।
বিএনপি প্রার্থী আজিজুরের দাবি, ছোট ভাই জামায়াত থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও ভোটারদের মাঝে প্রভাব ফেলবে না। ভোটাররা তাকেই বিজয়ী করবে বলে মনে করেন বিএনপি নেতা। তবে বিপরীত মত জামায়াত প্রার্থী মোস্তাকের। তার দাবি, জামায়াতের পক্ষে যে গণজোয়ার তৈরি হয়েছে। তাকে জনগণ নির্বাচিত করবে।
৪ আসনেই জেতার আশা বিএনপি ও জামায়াতেরঃ
জামায়াতের জেলা আমির মাওলানা আব্দুল মতিন ফারুকী বলেন, ‘আমরা সব ভোটারের কাছে যাচ্ছি। আমাদের ভোটের ময়দান অনেক ভালো। চারটি আসনে আমরা বিজয়ী হবো ইনশাআল্লাহ।’
তবে জেলার চারটি আসনেই বিএনপি জিতবে বলে আশা করছেন জেলা বিএনপির সদস্যসচিব সোহেল হোসনাইন কায়কোবাদ। তিনি বলেন, ‘বড় দল হিসেবে বিএনপিতে কিছু মতবিরোধ থাকলেও চারটি আসনে দলীয় প্রার্থীরা বিজয়ী হবেন। ঐক্যবদ্ধভাবে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন দলের নেতাকর্মীরা। জনগণ উন্নয়নের পক্ষে। উন্নয়নের স্বার্থে জনগণ ধানের শীষে ভোট দেবে।’ #
caller_get_posts is deprecated. Use ignore_sticky_posts instead. in /home/eibela12/public_html/wp-includes/functions.php on line 6121caller_get_posts is deprecated. Use ignore_sticky_posts instead. in /home/eibela12/public_html/wp-includes/functions.php on line 6121
Leave a Reply