সৈয়দ আমিরুজ্জামান :: জগত কর্মময়। সমগ্র বিশ্ব এক বিরাট কর্মশালা। এখনো কাজ চলে দিবা-রাত্র, বিরামহীনভাবে। বস্তুত কর্মময়তাই জীবন। মানব সভ্যতার ইতিহাস শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস। মানুষ ও মানুষের সমাজ প্রকৃতির অংশ। আর তাই মানব জাতির ইতিহাস, বিবর্তন ও জাতি গঠনের স্বরূপ তথা মানুষের উৎপত্তির ধারাকে পৃথিবীর বিকাশের ধারার মধ্যেই অনুসন্ধান করতে হবে।
মানুষের ইতিহাসকে সাধারণত জাতিতে জাতিতে যুদ্ধের কাহিনী বা দুই একজন রাজা বা সেনাপতি কিংবা রাষ্ট্রনায়কের কীর্তিকথারূপে চিত্রিত করা হয়। কখনও কখনও এইসব লোকের উদ্দেশ্যকে নিতান্ত ব্যাক্তিগত ব্যাপার হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। যেমন, কোনো ব্যাক্তি নেহাতই তার উচ্চাশার দরুন অন্য দেশ জয় করেন অথবা তার নীতির দরুন বিশেষ বিশেষ কাজ করেন ইত্যাদি। আসল কথা হলো, জনসাধারণই প্রকৃত ইতিহাস-বিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়।
মানব সমাজ বর্তমানে যে অবস্থায় আছে সেখানে কিভাবে এসে পৌঁছেছে, সমাজে পরিবর্তন কেন হয় এবং ভবিষ্যত মানুষের ইতিহাসে কি কি পরিবর্তন দেখা দেবে – এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছিলেন কার্ল মার্ক্স ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস। অনুসন্ধানের ফলে তাঁরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে সামাজিক পরিবর্তনগুলো কোনো আকস্মিক ব্যাপার নয়। সেগুলিও বহিঃপ্রকৃতির পরিবর্তনের মতো কতকগুলি নিয়ম অনুসারে ঘটে। এই সত্যের ভিত্তিতেই সমাজ সম্বন্ধে বিজ্ঞানসম্মত তত্ত্ব নির্মাণ করা সম্ভব হয়। সেই তত্ত্ব মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতার বনিয়াদের উপর প্রতিষ্ঠিত।
‘শ্রম যার সম্পদ তার’- এই নীতির পক্ষে ঐক্যবদ্ধতা, সংগঠন ও পরিবর্তনের গুরুত্ব দিতে গিয়ে কার্ল মার্কস আরও লিখেছেন, ”দার্শনিকরা জগতটাকে শুধু ব্যাখ্যাই করে গেলেন, মূল কাজ হচ্ছে বদলে ফেলা।”
স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রে বাঙালি ব্যতীত অন্যান্য জাতিসত্তার যেসব মানবগোষ্ঠীর বসবাস; দূর অতীত ইতিহাসের সূচনাকাল থেকে তারা সামাজিক, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের নানাবিধ অপপ্রয়াসে শাসক জাতের কাছে আজ আদিবাসী, উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ইত্যাদি পরিভাষার আক্রমণে পীড়িত। কতিপয় পোক্ত শিংয়ের অধিকারী সংস্কৃতি রাজ্যের সামন্ত অধিরাজের অবশ্য নৃগোষ্ঠী শব্দটি নিয়ে ঘোর আপত্তি। সে আপত্তির বিষয়ে দীর্ঘ ফিরিস্তি রয়েছে তাদের হাতে। এতদ্বিষয়ে আপত্তি থাকা অস্বাভাবিকও নয়। বিপন্নকে অনুকম্পা দেখানো যতটা সহজ; অধিকার দেয়াটা যে তার সহস্র গুণ কঠিন, তা হুঙ্কার ছুড়ে দেয়া ওই সব সিংহের চেয়ে বেশি কে জানে! তিনি বা তারাও শাসক বাঙালিরই অংশ- শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক স্বার্থচিন্তার শিকড় তার ও তাদেরও অস্তিত্বের গভীরে প্রোথিত। বলাবাহুল্য, মানুষকে হীনভাবে চিহ্নিত ও হতমান করবার উদ্দেশ্যে আবিস্কৃত উপর্যুক্ত পারিভাষিক শব্দগুলো সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপ কর্তৃক রফতানিকৃত। শতবর্ষ পূর্বের বাংলা ভাষার কোনো লেখা বা রচনায় যে ওই সকল পারিভাষিক শব্দ অনুসন্ধান করেও পাওয়া যাবে না, তা বলাই বাহুল্য। সাংস্কৃতিক ইতিহাসে ব্যবহৃত এমনতর অনেক শব্দ রয়েছে, যা এদেশে আগত পারমাণবিক ও রাসায়নিক অস্ত্রের পূর্ববর্তী ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী সংস্করণ। অধীনস্থ দেশের অধিবাসীদের তুচ্ছ করে মানসিকভাবে হত্যার নিমিত্ত সাম্রাজ্যবাদী শক্তি প্রকৃতির সন্তান মানুষকে গাত্র বর্ণ, চক্ষু, নাসিকা, কপাল, চোয়াল, চুল ও গাত্রলোমের মানদণ্ডে বিভাজিত করে ইউরোপয়েডদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছে জগৎ শাসনের অভিপ্রায়ে। শাদা মানুষ ঈশ্বর কর্তৃক কালো মানুষকে শাসনের অধিকার লাভ করেছে- কালো মানুষের উপর চাপিয়ে দেয়া নিপীড়নের মধ্য দিয়ে যেন সেদিন ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী ক্ষমতাবান মানুষ তাই বলতে চেয়েছিল। কালো মানুষের উপর চাপিয়ে দেয়া সেই অমানবিক হিংস্র আক্রমণ, পীড়ন, নিপীড়ন ও শোষণের নিত্যনতুন কৌশল প্রয়োগ এবং ক্রীতদাসে পরিণত করবার ইতিবৃত্ত আফ্রিকা, আমেরিকার কালো মানুষের সাহিত্যে (ব্ল্যাক লিটেরেচার) বিধৃত। সেদিন ওই সকল পারিভাষিক শব্দ তারা ব্যবহার করেছে কালো মানুষকে বর্বর, অসভ্য বলে গাল দিয়ে তাকে হেয় করবার জন্যে; আজ ব্যবহার করছে কালো মানুষ বা অনগ্রসর জনমানুষের অগ্রগতিকে প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়ে তাদের কাছে আপন উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরবার প্রয়োজনে। এই উদারতাও যে নিঃস্বার্থ, তা তো নয়।
ভালোবাসা নামক বুর্জোয়া প্রত্যয়টি ব্যবহার করে অবহেলিত জনগোষ্ঠীর নিকট নিজকে স্বজাতির বহমান স্রোত থেকে বিশিষ্ট করে দেখানোর প্রয়াস বৈ আর কিছু নয়। এই উদার দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে আছে সেই রাজনীতি, যা দ্বারা অবহেলিত অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে আর একবার বুঝিয়ে দেয়া- আমি না দিলে আজও কোনো কিছুই তুমি পেতে পারো না। এমনকি তোমার অস্তিত্বের স্বীকৃতি; সেও আমার দয়ায়ই তুমি পেতে পারো। আমার সভ্যতার অজস্র উপকরণের দ্বারা তোমাকে মানুষের সংস্কৃতির জগতে ছাড়পত্র দিয়েছি। তুমি দ্বিপদ পশু ছিলে, তোমাকে মানুষ করে গড়েছি আমি। ভাষা, বিজ্ঞান, আলো-অন্ধকার, জীবন-মরণ, সুখ-দুখের অনুভূতি, খাদ্য-অখাদ্যের ও ভালো-মন্দের জ্ঞান, রোগের চিকিৎসা, পরনের বস্ত্র, সম্পদের জন্য যুদ্ধ-মারণাস্ত্র এ-সবই তোমাদের জন্য আমার উপহার। অতএব তোমরা বংশপরম্পরায় আমার দাসানুদাস।
Uncivilisation, Barbarian, Savge, Aborgeneous- এই সকল পরিভাষার উদ্ভাবক ইউরোপের ক্ষমতাবান রাষ্ট্রের নাগরিক বিদগ্ধজন। যেদিন তারা অন্য ভৌগোলিক অঞ্চলে নিজেদের উপনিবেশ বা আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ভিন্ন আত্মস্বার্থ সিদ্ধির কোনো উপায় খুঁজে পাননি তখন উপর্যুক্ত পারিভাষিক শব্দগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে বিজিত নির্বাচিত দেশের জনগণকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দিত। সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্ব দ্বারা বিজিতদের হেয় প্রতিপন্ন করা যতটা সহজ, বল প্রয়োগ বা মারণাস্ত্রের সাহায্যে ঠিত ততটাই কঠিন। ক্ষমতাবান অন্যকে দুর্বল করে শাসন ও শোষণ করে আনন্দ পায় এবং আধিপত্য বজায় রাখার জন্যে নিত্যনতুন কৌশল আবিস্কার করে। শাসিত রাষ্ট্রের নিজস্ব সংস্কৃতির পরিবর্তে শাসক তাদেরকে নিজ সংস্কৃতির উপর নির্ভরশীল করে তোলে। সাংস্কৃতিক ক্ষমতা হারিয়ে শাসিত জাতি দেউলিয়ায় পরিণত হয়। ঔপনিবেশিক শক্তির কবল থেকে মুক্ত স্বাধীন জাতি যখন আপন সংস্কৃতির বিকাশ সাধনে তৎপর তখন জাতীয়তাবাদ, জাতীয় সংস্কৃতি ইত্যাদি সংকীর্ণতা দোষে দুষ্ট। দুর্বল জাতি বা রাষ্ট্রের উপর ক্ষমতার অধিকারী রাষ্ট্র বা জাতির এক ভয়াবহ চাপ সকল অবস্থায়ই বিদ্যমান থাকে। তাদের সকল কর্মে ক্ষমতারই বাহাদুরি প্রকাশ পায়, কেবল কায়দাটা ভিন্ন ভিন্ন।
প্রাচীন ভারতবর্ষে আধিপত্যবাদী আর্য জাতি নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করবার জন্য স্থানীয় অধিবাসীদের অনার্য, বানর, রাক্ষস ইত্যাদি নামে শনাক্ত করে। শ্রমবিমুখ আর্যগণ উৎপাদক শ্রেণিকে চতুর্বর্ণের চাতুরীর ফাঁদে ফেলে অস্পৃশ্য করে রাখে শতাব্দীর পর শতাব্দীকাল। ধর্ম ও সমাজনীতির অমানবিক সেই শোষণ প্রক্রিয়া সহস্র বছর বিচিত্ররূপে অব্যাহত থাকে। ধর্মীয় অনুশাসন, ভাষার আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্থানীয় ভাষার স্বাভাবিক বিকাশকে ব্যাহত করে রাখে বিভিন্ন প্রাকৃতিক ভাষার উন্মেষকাল পর্যন্ত। অষ্টাদশ পুরাণ, উপপুরাণাদি সংস্কৃত ভাষা বা দেবভাষা ভিন্ন অন্য কোনো ভাষায় চর্চা করলে তাদের স্থান হবে রৌরব নামক স্থানে এমন নিষেধবাণী প্রচার করে। এই তো সেদিন সেনবংশের শাসনামলে বাংলা ভাষার বিকাশ রোধ করবার চষ্টা করা হয়েছিল। ভারতীয় জনগণকে বহুবর্ণে বিভক্তকরণের আর্যনীতি ছিল মূলত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ধর্ম এবং কঠোর ধর্মীয় অনুশাসন ছিল আর্য জাতির মারণাস্ত্র আধিপত্য বিস্তার ও তা বজায় রাখার নিয়ামক শক্তি। বাঙালি প্রাচীন ভারতবর্ষের আধুনিক উত্তরাধিকার। ভূমধ্যসাগরীয় (দ্রাবিড়), নিগ্রোয়েড, ককেশিয়ান, প্রি-অস্ট্রোলয়েড, মঙ্গোলয়েড মহাজাতির সংমিশ্রণে বহু শতাব্দীর সহাবস্থানের ফলে তাদেরই রক্ত সাংকর্যে বাঙালি জাতির উদ্ভব। অতএব বাঙালির সংস্কৃতিও বিভিন্ন জাতিসত্তার সংস্কৃতির সমন্বিত, পরিশীলিত ও প্রকর্ষণের পরিণাম।
বাঙালি সংস্কৃতি বিভিন্ন জাতিসত্তার সংস্কৃতির নির্যাস প্রসূত হবার পরও আলোচ্য প্রস্তাবনার যৌক্তিকতা এখানেই যে, বিভিন্ন আদিবাসীর নরনারী বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে একালেও তাদের জীবনলীলা অব্যাহত রেখেছেন। নিজস্ব সমাজ কাঠামোর মধ্যে সুনির্দিষ্ট রীতিনীতি, প্রথা-পদ্ধতি, উৎপাদনের উপায়, উপকরণ, ধর্ম-কৃত্য, লোকাচার, বিশ্বাস-সংস্কার ইত্যাদির অভিব্যক্তিরূপে তারা সংস্কৃতির একটা চলিষ্ণু প্রবাহ সৃজন অব্যাহত রেখেছে। আবার ঐতিহ্যের অনুষঙ্গগুলোও পরিত্যাগ করেনি। কারণ হারাবার ভয়ে সে তা আঁকড়ে থাকে সকল সময়। আর্থনীতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ার কারণে পরনির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পায়। প্রগতির সড়কের চলমান মিছিলে যোগ দেয়া তাই সম্ভব হয় না। পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই এরূপ অনগ্রসর নৃগোষ্ঠীর অস্তিত্ব রয়েছে। কোথাও কোথাও তারা এখনও শিকার যুগ অতিক্রম করতে পারেনি। জুম পদ্ধতির চাষাবাদের ওপর অনেকেই নির্ভরশীল। ক্ল্যান, মইট্টি, ফেইট্রির স্তর অতিক্রান্তের পর প্রতিষ্ঠিত হয় রাষ্ট্র। কৃষিজীবী সমাজ থেকেই অবসরভোগী, উৎপাদনবিমুখ এই শাসকগোষ্ঠীর আবির্ভাব। তারা ছিল নিজেদের বুদ্ধিমত্তা দ্বারা অন্যের ওপর আধিপত্য বিস্তারে সদা সচেতন। গোত্র বা গোষ্ঠীপতি, পুরোহিত, পুরোহিত-সম্রাট, বীরযোদ্ধা বা সেনাপতি- অতঃপর সম্রাট বা রাজা। সময়ের ব্যবধান সত্ত্বেও সভ্যতার বিবর্তনের এই ধারাটি পৃথিবীর সর্বত্র অনুসৃত হয়েছে। লক্ষণীয়, শক্তি নয়; ক্ষমতা ও বৌদ্ধিক কৌশল সকল যুগেই নেতৃত্ব বা চালকের আসনে বসে ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রণ করেছে গোত্র, সমাজ বা রাষ্ট্রের সব কর্মকাণ্ড। পুঁজি সৃষ্টির পূর্বে বীরত্বই ছিল একজন বীরের পুঁজি। তার অসম সাহস, শক্তি ও কৌশলকে পুঁজি করে বীর ভূখণ্ডের পর ভূখণ্ড দখল করেছে- স্বয়ং পূজিত হয়েছে অধিবাসীদের দ্বারা। নতমস্তকে তার অধীনতা মেনে নিয়েছে পার্শ্ববর্তী ক্ষমতাবান শাসকরা। গ্রিক সম্রাট আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট একই পুঁজির ওপর ভর করে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন ভারতবর্ষ পর্যন্ত।
প্রাচীন সকল সাম্রাজ্যই এইভাবে পেশিশক্তি ও ক্ষমতার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পেশিশক্তি যন্ত্রশক্তিতে রূপান্তরের সঙ্গে সঙ্গে শক্তির স্থান দিয়েছে ক্ষমতা। এবং সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে দেখা যায় প্রাচীন গোষ্ঠীপতি, পুরোহিত, পুরোহিত-সম্রাট, সেনাপতি ও সম্রাটগণ পেশিশক্তির দ্বারা ক্ষমতাবান হয়েছিলেন। বর্তমানকালে প্রশাসনযন্ত্রের প্রধান ক্ষমতার দ্বারা শক্তিমান হন। একালে শক্তি-অদৃশ্য ক্ষমতাই দৃশ্যমান। জনগণই ক্ষমতার উৎস বলে যে রাষ্ট্রযন্ত্রের পরিচালকের আসনে বসে; আসন অলঙ্কৃত করবার পর সে প্রথমেই প্রমাণ করে- জনগণ ক্ষমতাহীন। জনগণকে ক্ষমতাহীন করে নিজে শক্তিশালী হয়ে ওঠে ক্ষমতার বিধি অপব্যবহারের মাধ্যমে। ক্ষমতা তাকে শক্তিমান করায় সে স্বয়ং অন্ধ হয়ে পড়ে। সর্বত্র আলো থাকায় তার আসনের চারদিক থাকে অন্ধকারে ঢাকা। জনতার শত্রুরা সেই অন্ধকারে বসে রাষ্ট্রের যারা মালিক সেই জনগণকে হতমান, শক্তিহীন, সম্বলহীন, নিঃস্ব করার যাবতীয় ফাঁদ তৈরি করে। ক্ষমতা-অন্ধ সে কিছুই দেখে না; সে বধির, কিছু শুনতেও পায় না; বোবা, কিছু বলতেও পারে না। এভাবে ক্ষমতা জনগণের কাছে সর্ববিষয়ে অক্ষম একটি প্রতিবন্ধী অস্তিত্বে পরিগণিত হয়। ক্ষমতা বরাবরই চায় নিরঙ্কুশ হতে। হতে চায় অপ্রতিরোধ্য, একাধিপতি। প্রতিপক্ষ কেউ থাক তা কাঙ্ক্ষিত নয় বলেই দমন-পীড়ন দ্বারা ক্ষমতার হিংস্র রূপটি সর্বসমক্ষে তুলে ধরে নির্মমভাবে। দমন-পীড়নের শিকার হয়েই দুর্বল জনগণের একটি অংশ, যারা এককালে ক্ষমতাবান ছিল কিংবা ক্ষমতার কাছাকাছি ছিল তারা প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে যেতে বাধ্য হয়। পৃথিবীব্যাপী অস্তিত্বশীল মহাজাতিসমূহের বিভিন্ন গোষ্ঠী উপর্যুক্ত প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীতে। ক্ষমতাহীন, আর্থনীতিকভাবে পশ্চাৎপদ, আদিম উৎপাদন ব্যবস্থার গণ্ডিতে আবদ্ধ, আধুনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত, ব্যবহারিক বিজ্ঞানের সংস্পর্শহীন এই সকল জনগোষ্ঠী সবল ক্ষমতাসীনদের চাপে হারিয়েছে ভূমির অধিকার; হারিয়েছে আপন মাতৃভাষা, ধর্মবিশ্বাসে দিতে হয়েছে নানা জোড়াতালি। চরম অবহেলা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষমতাবানদের চাপ ও ভয়ে দুর্গম অরণ্য, পাহাড় কিংবা দেশের প্রান্তসীমায় আশ্রয় নিয়েছে অপরাধীর মতো। পৃথিবীর অন্য সব দেশের মতো বাংলাদেশেও সংখ্যালঘু এই জনগোষ্ঠী প্রচণ্ড ঝুঁকির মধ্যে অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। অভিন্ন রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও প্রবল ক্ষমতাবান শাসক জাতির দ্বারা নিগৃহীত, উপজাতি বলে অবহেলিত তাদের জীবনের মতোই নিরাপত্তাহীন জনগোষ্ঠীগুলোর ভাষা ও সংস্কৃতি।
বলাবাহুল্য, অভিন্ন দেশসীমায় বসবাসকারী সাঁওতাল, ওঁরাও, মুণ্ডা, রাজবংশী, গারো, হাজং, খাসিয়া, মালপাহাড়ি, মণিপুরি, ত্রিপুরা, ম্রো, পাঙ্খো, বোম, তঞ্চঙ্গ্যা, মারমা, রাখাইন, চাকমা ইত্যাদি আদিবাসী শাসক জাতি বাঙালির সমান্তরালে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক, আত্মিক ও আধ্যাত্মিক প্রয়োজনে তাদের নিজ নিজ সংস্কৃতির সীমায় জীবন নির্বাহ করে। সংস্কৃতির সাধারণীকরণ সম্ভব নয় বলেই একই দেশে সংস্কৃতির বিভিন্নতা স্বাভাবিক। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলার অধিবাসীরা অভিন্ন ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশে একই আর্থনীতিক উৎপাদন ব্যবস্থার অধীনে জীবন নির্বাহ করা সত্ত্বেও এই সব জেলার অধিবাসী চাকমা, মারমা, ম্রো, বোম প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর প্রত্যেকেই স্বতস্ত্র সংস্কৃতির ধারক। উপর্যুক্ত জনগোষ্ঠীর সকলেই আবার মঙ্গোলয়েড মহাজাতির অন্তর্গত। এ দৃষ্টান্ত থেকে এটা অত্যন্ত স্পষ্ট যে, জাতিতাত্ত্বিক বা নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যই কেবল সংস্কৃতির নিয়ামক নয়।
ঔপনিবেশিক প্রত্যেক শাসকগোষ্ঠীর সংস্কৃতি নির্বিচারে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে বাঙালি। নৈর্ব্যক্তিক ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিচারপূর্বক ড. আহমদ শরীফ সম্রাট কনিস্ক ব্যতীত তিন হাজার বছরের বাংলার ইতিহাসে আর কোনো বাঙালি শাসকের অস্তিত্ব খুঁজে পাননি। অর্থাৎ ঐতিহাসিককালের তিন হাজার বছর বাঙালি ঔপনিবেশিক শাসকের অধীনে ছিল। আর্য, মৌর্য, সুঙ্গ, কুশান, গুপ্ত, পাল, সেন, তুর্কি, আফগান, মুঘল, ফরাসি, ওলন্দাজ, পর্তুগিজ, ইংরেজ ইত্যাদি জাতির দ্বারা দীর্ঘকাল শাসিত হবার ফলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও জীবন-জীবিকা সংক্রান্ত নানাবিধ কারণে উপর্যুক্ত জাতির সাংস্কৃতিক আধিপত্য বরণ করে নিতে বাধ্য হয়। পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে, এক সংকর জাতিসত্তা বাঙালির সংস্কৃতিও সংকর। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে বাঙালি নিজস্ব সংস্কৃতির শিকড় সন্ধানী হয়েছে বটে, কিন্তু এককভাবে কোনো সংস্কৃতির জনকের দাবিদার হতে পারেনি। ব্যবহারিক প্রয়োজনেই বাঙালিকে শাসকগোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে গ্রহণ করতে হয়েছে আত্তীকরণের নিয়মে। কিন্তু ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসকচক্র এদেশীয় জনসাধারণের উপর প্রথমাবধি সাংস্কৃতিকভাবেই আধিপত্য বিস্তারে সচেষ্ট ছিল। ইউরোপীয় শাসকগোষ্ঠীর ন্যায় মধ্যএশীয় আধিপত্যবাদ এদেশে শাসকের বেশেই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। অন্যভাবে বলা যায়, রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে সে ছিল দুর্বল সামন্ততন্ত্রের উপর অপেক্ষাকৃত সবল সামন্ততন্ত্রের বিজয়।
অপরদিকে, ইংরেজ বুর্জোয়া বণিকবৃত্তি থেকে শাসক হয়ে ওঠে রাষ্ট্রশক্তির দুর্বলতার সুযোগে। ততদিনে তার কাছে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, রোমান ক্যাথলিক ধর্ম, ইউরোপীয় রেনেসাঁস-প্রসূত জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শন ও অষ্টাদশ শতকের এনলাইটেনমেন্ট-জাত প্রগতির প্রতিতুলনায় স্বকালের ভারতবর্ষীয় সমাজ প্রগতি অনগ্রসর। এবং প্রাচীন ভারতীয় ধর্ম-দর্শন, সামাজিক কুসংস্কার ও অমানবিক বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় প্রথার নিগড়ে বাঁধা এদেশীয় জনগণ। ইংরেজ রাষ্ট্রশক্তির আমদানিকৃত ইউরোপীয় সংস্কৃতির বিবিধ উপকরণ তাদের উপর জাদুশক্তির মতো কাজ করবে। রাষ্ট্রক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী, নিরঙ্কুশ করবার অভিপ্রায়ে তাই তারা সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকেই নিয়ামক নির্ধারণ করেছিল। সেই সূত্রেই ধর্মান্তর ক্রিয়া, আর্থনীতিক সংস্কার (অভ্যন্তরীণ ও বহির্বাণিজ্য করায়ত্ত করা, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, সূর্যাস্ত আইন ইত্যাদি), সামম্প্রদায়িক বিরোধের বীজ উপ্ত করে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যকার সংহতি ও সম্প্রীতি বিনষ্ট করার মতো বিভিন্ন কূটরাজনীতির আশ্রয় গ্রহণ করে। একই সঙ্গে ভারতবর্ষীয়দের নিকট অপরিচিত ইউরোপীয় সংস্কৃতির উৎকৃষ্ট, অপকৃষ্ট সকলই সুকৌশলে উপস্থাপন করে। সেই সর্বনাশকালে এতদঞ্চলের মানুষের পক্ষে নিজস্ব সংস্কৃতির কতটা গেল, কতটা রক্ষা পেল তা বিচার করবার অবকাশ ছিল না। স্বদেশী যুগের পূর্বে বাবু কালচারের বিচিত্র অনাচারকালেই কেবল সাংস্কৃতিক প্রতিরোধচিন্তার উন্মেষ ঘটেছিল- এ কথা বলাই বাহুল্য। বলা যায়, ইউরোপীয় ভিন্নধর্মী সংস্কৃতির তরঙ্গাভিঘাতে বাঙালি মানস উন্নততর সচেতনতায় পৌঁছাবার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে অকস্মাৎ। যে বস্তুটি হারালে মানুষের আত্মার অপঘাত মৃত্যু ঘটে। আন্তোনিও গ্রামসির দৃষ্টিতে দেখলে স্পষ্ট হয় সংস্কৃতি মানব অস্তিত্বের কত বড় শক্তি। -সংস্কৃতি একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের জিনিস। এ একটা সংগঠন, আমাদের ভেতরের অহংকে নিয়ন্ত্রণে আনা, আমাদের ব্যক্তিত্বের ওপর কর্তৃত্ব বিস্তার করা এবং একটা উন্নততর সচেতনতায় পৌঁছানো যার মাধ্যমে আমরা আমাদের স্বকীয় ভূমিকা এবং আমাদের নিজস্ব অধিকার ও কর্তব্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হই। (খন্দকার সাখাওয়াত আলী, ২০২১, ৯৫)
অর্থাৎ অহংকে নিয়ন্ত্রণে এনে, আপন ব্যক্তিত্বের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উন্নততর সচেতনতার স্তরে পৌঁছানো এবং স্বীয় অধিকার ও কর্তব্য সম্বন্ধে উপলব্ধি করবার ক্ষমতা জোগায় সংস্কৃতি। আত্মপরিচয় ও আত্মোপলব্ধির ব্যক্তিক ক্ষমতাটা যে জাতি বা গোষ্ঠী বিসর্জন দিয়ে বসে, তার বিপন্ন অস্তিত্ব রক্ষার কোনো উপায় থাকে না। বাঙালি অষ্টাদশ শতক থেকে উনিশ শতকের প্রথম এক দশক পর্যন্ত তার সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে বিজাতীয় সংস্কৃতির প্লাবনস্রোতে ভেসে গিয়েছিল। সেই জাতীয়তার বোধের পুনর্জাগরণ ঘটে বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে। ভাষার অধিকার, স্বাধিকারের চেতনা প্রবল ও অপ্রতিরোধ্য হলে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় পরিণতি খোঁজে। গণতান্ত্রিক অধিকার বাস্তবায়নের প্রতিবন্ধতা উপড়ে ফেলতে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ছিল অনিবার্য। ভৌগোলিক স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করবার পরও মনস্তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জীবনে পূর্বতন সাংস্কৃতিকবোধ স্বাধীন বাংলাদেশে অবশেষ রূপে থেকে যায়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত সময় স্বাধীন বাংলাদেশের একটি ছোট্ট অধ্যায়। মানস-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের কর্মী শিল্পী-সাহিত্যিক-কবি-নৃত্য ও সঙ্গীত শিল্পীরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে বাঙলি সংস্কৃতির গৌরবময় ঐতিহ্যের ভিতে নতুন আগামী সৃজন প্রয়াসে সক্রিয় হলেন এ সময়েই। বাঙালির দেশের গান, কবিতা, নাটক, উপন্যাস, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, নৃত্যকলায় স্বদেশ, ইতিহাস, ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধ মুখ্য প্রতিপাদ্য হলো। স্বদেশ, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক শিকড়ানুসন্ধানী গবেষণায় ব্যাপৃত হলেন গবেষকরা। আত্মানুসন্ধানের সেকালের অভিযাত্রাকে সংস্কৃতিকর্মীরা শনাক্ত করলেন শিকড়সন্ধানী অভিযাত্রা নামে। কিন্তু আর্থনীতিক উৎপাদন ব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন না ঘটায় ব্যবহারিক সংস্কৃতি রয়ে যায় এক অনড় অবস্থানে। যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় ও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে অবাধ লুণ্ঠনের পর ১৯৭২-১৯৭৫ পর্যন্ত সরকার ছিল কেবল বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীল। পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসের একদিন পর ১৭ আগস্ট ১৯৭৫ সালে সপরিবারে জাতির জনকের নিহত হবার ঘটনা অত্যন্ত সচেতনভাবে সংঘটিত সুদূরপ্রসারী একটি রাজনৈতিক পরিকল্পনার অধীনে পরিচালিত হত্যাযজ্ঞ। বাঙালির স্বাধীনতার মৌল উদ্দেশ্য পাকিস্তানের মতো সামরিকতন্ত্র দ্বারা পদদলিত হলো। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র পবিত্র সংবিধান থেকে মুছে ফেলে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠা ও ইসলামী আদর্শকে রাষ্ট্রধর্ম করবার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি ছাতার নিজে ঢুকিয়ে দেয়া হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে। এ সময় থেকেই স্বাধীন দেশে সংস্কৃতির যে-চেতনা নিজস্ব অধিকার ও কর্তব্য উপলব্ধির ক্ষমতা, তা হারাতে বাধ্য হয় বাঙালি। হাজার হাজার বছরের জীবন পরিক্রমায় সৃষ্ট বাঙালির সংস্কৃতি বর্তমানে এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এহেন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে বসবাসরত আদিবাসী বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জীবন ও সংস্কৃতি ভিন্নতর বিবেচনার দাবি রাখে। বলাবাহুল্য, বাংলাদেশে বসবাসরত আদিবাসী জনগোষ্ঠী নৃবৈশিষ্ট্যে অস্ট্রোলয়েড, মঙ্গোলয়েড মহাজাতির অন্তর্গত অস্ট্রিক, দ্রাবিড় জাতির রক্ত ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকার। বিশেষজ্ঞরা তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, আদিতে বাঙালির সংস্কৃতি গড়ে ওঠে উপর্যুক্ত মহাজাতির সাংস্কৃতিক উপাদান উপকরণের সমন্বয়ে। অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় গোষ্ঠীর অনেক ব্যবহার্য বস্তুর নাম, আচার-সংস্কার, রীতি-নীতি, ভাষার শব্দাবলি, কৃত্য ও কীর্তির অনেক কিছুই আধুনিক বাঙালির সংস্কৃতিতে আজও বিদ্যমান। পরে আলপাইন মানবগোষ্ঠীর আর্য জাতির উপনিবেশ সৃষ্টি হলে অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় জাতির উত্তরাধিকারীরা শাসকগোষ্ঠীর চাপে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে আর্যভাষীদের বিরোধের ফলে আর্য গ্রন্থাদিতে অনার্য, অসুর, বানর, রাক্ষস, চণ্ডাল ইত্যাদি শব্দমালার সৃষ্টি। ইতিহাসের সাক্ষ্য অনুযায়ী, সংখ্যাগরিষ্ঠ অনার্যদের সঙ্গে আপস করেই আর্যভাষীরা নিজেদের ভাষা সংস্কার করতে বাধ্য হয়েছিল। সংস্কৃত ভাষা সেই অনার্য, আর্য ভাষার সমন্বিত ও সংস্কৃত রূপ। কালের প্রবাহে আর্যভাষীরা রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার পর স্থানীয় অধিবাসীদের উপর পূর্ণ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করে। ক্ষমতার দাপটে আর্যরা বিজিতদের অর্জিত সম্পদ, ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি- সবকিছু হরণ করে। আর্যধর্মে বর্ণশ্রেণীর উদ্ভবের মূলে ছিল অস্ট্রিক, দ্রাবিড় গোষ্ঠীকে উৎপাদকে পরিণত করার হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। রাজদ- ও শাস্ত্রগ্রন্থের শক্তিতে বলীয়ান আর্যরা ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী ও নিরঙ্কুশ করবার হীন অভিপ্রায়ে উৎপাদক বৈশ্য ও শূদ্রের জন্য শাস্ত্রগ্রন্থ পাঠ নিষিদ্ধ করে। এহেন পরিস্থিতিতে শাসকশ্রেণীর অবর্ণনীয় চাপ সত্ত্বেও যারা সেদিন আর্য ধর্ম গ্রহণ করেনি সেই সব অস্ট্রিক, দ্রাবিড় ও মঙ্গোলয়েড মানুষ দেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের অরণ্য ও পাহাড়ে আশ্রয় গ্রহণ ও আত্মরক্ষা করে। আজকের সাঁওতাল, মুণ্ডা, ওঁরাও, কোল, ভীল প্রমুখ সেদিনের পরাজিত হতমান অস্ট্রিক, দ্রাবিড় গোষ্ঠীর আধুনিক প্রতিনিধি। হাজং, রাজবংশী, গারো, চাকমা, মারমা, ম্রো, ত্রিপুরা, খিয়াং, খুমি, তঞ্চঙ্গ্যা, রাখাইন, বোম, পাঙখোয়া, লুসাই, চাক ইত্যাদি জনগোষ্ঠী মঙ্গোলয়েড মহাজাতির উত্তরাধিকার হিসেবে আজও পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রক্ষা করে চলেছে।
এককালের শাসিত বাঙালি আজ শাসক জাতি। উপর্যুক্ত জনগোষ্ঠী সকলেই তার শাসনদণ্ডের অধীন। দেশের প্রান্তবর্তী জেলাগুলোর অরণ্য, পাহাড়ে বসবাসরত সংখ্যালঘু উপর্যুক্ত জনগোষ্ঠী শাসক জাতির দ্বারা শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত। চিরন্তন নিয়মে ক্ষমতার প্রচণ্ড প্রভাবে অন্ধ ক্ষমতাধর অন্য সকল শাসকগোষ্ঠীর মতো বাঙালিও শাসক জাতিরূপে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানবিক অধিকার অগ্রাহ্য করছে। বাঙালি কর্তৃক বেদখল হচ্ছে আদিবাসী জনতার সম্পত্তি। প্রাযুক্তিক জ্ঞানের অভাবে তারা আর্থনীতিক প্রগতির মিছিলে শরিক হতে পারেনি। মঙ্গোলয়েড শাখার সকল জনগোষ্ঠীই অদ্যাবধি জুমী। ভূত-প্রেত, অশুভ আত্মায় বিশ্বাসী আদিবাসী জনতা আধুনিক চিকিৎসার আওতায় না আসায় মন্ত্র-তন্ত্র, তুক-তাক, ঝাড়-ফুঁক, জাদু-টোনার ওপর নির্ভরশীল। মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের অধিকার নেই তাদের। দক্ষিণ-পূর্ব পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসী আদিবাসীরা আজও পাহাড়ের টিলায় টঙ ঘরে জীবন যাপন করছে। বরেন্দ্র অঞ্চল ও বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসী আদিবাসীরা সমতলে বসবাস করে। কিন্তু তাদের আর্থনীতিক দীনতা অবিশ্বাস্য। শাসক বাঙালি উপর্যুক্ত জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন প্রশ্নে প্রয়োজনীয় গুরুত্ব প্রদান করছে- এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। সমগ্র দেশের সামগ্রিক অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আদিবাসী জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত অঞ্চলের অবকাঠামোগত উন্নয়ন বিষয়ে উল্লেখযোগ্য সরকারি উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। দেশের মোট ভূমির অর্ধেকাংশে বসবাসরত নাগরিকদের জীবনমানের উন্নয়ন ব্যতীত জাতীয় উন্নতি যে সম্ভব নয়- এই সাধারণ সত্যটি আজ পর্যন্ত শাসকগোষ্ঠী উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়নি। কিংবা তা উপলব্ধি করলেও তার সত্যতা স্বীকার করে না। ফলে পার্বত্য তিনটি জেলায় আদিবাসী জনগোষ্ঠী প্রথমে আন্দোলন, পরে সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। এর ফলে আদিবাসী পাহাড়ি জনগোষ্ঠী ও সামরিক বাহিনীর মধ্যে দীর্ঘ দিন আক্রমণ-প্রতিআক্রমণের ঘটনা ঘটে। ফলে ১৯৭২-১৯৯৯ পর্যন্ত আদিবাসী জনগোষ্ঠী স্বাধিকার আন্দোলনের অংশ হিসেবে সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করে। উপর্যুক্ত সময়ে আদিবাসী-বাঙালি সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। জুলুম, নির্যাতন, লুণ্ঠন, হত্যা, ধর্ষণ চরম মাত্রায় পৌঁছলে আদিবাসীর সাংস্কৃতিক জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। লক্ষাধিক আদিবাসী পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। বাংলাদেশের ইতিহাসের সে অধ্যায় অবিস্মরণীয় দুঃস্বপ্নের। ১৯৯৯ সালে স্বাক্ষরিত শান্তিচুক্তি বাঙালি-আদিবাসী সম্পর্কের নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। কিন্তু পার্বত্য ভূমি আইন চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত সে সম্পর্কের গ্রন্থি কতটা সুদৃঢ় তা বলা দুরূহ।
মুক্তবাজারের ছোঁয়া আদিবাসী চৈতন্যেও পরিবর্তনের দোল দিয়েছে। কিন্তু তা সামাজিক চেতনার বিকাশের গুণগত ও পরিমাণগত পরিবর্তনের ফল নয়। তা নয় বলেই এটা টেকসই কোনো পরিবর্তনও নয়। এ সত্য উপলব্ধি করে আদিবাসী নেতৃবৃন্দ গোষ্ঠীগুলোর সদস্যদের (মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থী) মাতৃভাষায় লিখতে পড়তে শেখাবার প্রকল্প হাতে নিয়েছেন (বান্দরবান, উপজাতীয় কালচারাল একাডেমির পরিচালক প্রদত্ত তথ্যমতে)। উপর্যুক্ত প্রকল্পের অধীনে মারমা, বম, ম্রো ও তঞ্চঙ্গ্যা- এই চারটি ভাষাভাষীর সদস্যদের স্ব স্ব মাতৃভাষা শেখানোর প্রয়াস চলছে। একই সঙ্গে তারা জাতিগত নৃত্য, সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্র শিক্ষাদানের ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছে।
চা শিল্প উনিশ শতকে সিলেটে এবং আসামে চা শিল্পের বিকাশ ঘটে। প্রধানত ব্রিটিশ (ইংরেজ, স্কটিশ, আইরিশ) চা-করগণ (ঞবধ চষধহঃবৎং) সিলেটের টিলাভূমি এবং আসামের উচ্চভূমিতে ব্যাপক এবং বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চা উৎপাদনের সূচনা করে। ১৮৩৯ সালে বেশকিছু ব্রিটিশ পুঁজিপতি এবং ভারতীয় ধনাঢ্য ব্যবসায়ী যেমন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, বাবু মতিলাল শীল, হাজী হাশেম ইস্পাহানি এবং অন্যান্যদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয় আসাম টি কোম্পানি। লন্ডনে আনুষ্ঠানিকভাবে এই কোম্পানির নাম ঘোষণা দেওয়া হয়। ১৮৩৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি কোম্পানির প্রাথমিক মূলধন ছিল প্রায় ৩ লক্ষ পাউন্ড (৫ লক্ষ ডলার)। এই কোম্পানি গঠনের পরপরই কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল টি এসোসিয়েশন এর সঙ্গে একীভূত হয়।
রবার্ট ব্রুস ১৮৩৪ সালে আসামের উঁচু অঞ্চলে চা গাছের সন্ধান পান। এরপর ১৮৫৫ সালে সিলেটের চাঁদখানি টিলায় দেশীয় জাতের চা গাছের সন্ধান মেলে। একই সময়ে খাসি ও জৈন্তা পাহাড়েও ‘বন্য প্রজাতির’ চা গাছের সন্ধান পাওয়া যায়। ১৮৪০ সালে চট্টগ্রামেও চা উৎপাদন শুরু হয়। এখানে চা উৎপাদনের জন্য চীন থেকে চারা আমদানি করা হয় এবং কলকাতা বোটানিক্যাল গার্ডেনে উৎপাদিত চীনা প্রজাতির চা গাছ রোপন করা হয়। ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনিছড়ায় বাংলাদেশের প্রথম চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৬০ সালে লাল চাঁদ ও মাটিরাঙ্গা নামে আরো দুটি চা বাগান প্রতিষ্ঠা করা হয়।
প্রথমদিকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে চা বাগান প্রতিষ্ঠা শুরু হয়। কিন্তু উনিশ শতকের ষাটের দশকে ব্যাপক মন্দায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে চা বাগান প্রতিষ্ঠার তৎপরতা বন্ধ হয়ে গেলে চা শিল্প ধীরে ধীরে বড় বড় কোম্পানির আয়ত্তে চলে আসে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, ওই মন্দার পর সিলেটের চা শিল্পে জেমস ফিনলে নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। তবে উনিশ শতকের শেষদিক হতে ক্ষুদ্র একটি দেশীয় উদ্যোক্তা শ্রেণি চা শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত হয়। তবে দেশিয় উদ্যোক্তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হলেও বিদেশি কোম্পনিগুলির আধিপত্য কখনই বিঘ্নিত হয় নি। কারণ প্রযুক্তিগত জ্ঞান এবং চা বিপণনের জন্য দেশিয় চা করগণ ইউরোপীয়দের উপরই নির্ভর করত। তবে এই শিল্পের মাধ্যমেই দেশীয় ও বিদেশি উদ্যোক্তাদের মধ্যে এক ধরণের সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে উঠে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর দেশীয় চা বাগানের অনেক হিন্দু মালিক দেশ ত্যাগ করেন এবং ১৯৪৭-৭১ কালপর্বে এই শূণ্যস্থান দখল করে পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু পুঁজিপতি এবং উত্তর ভারত থেকে পাকিস্তানে আগত উর্দুভাষী মুসলিম ধনিক শ্রেণি।
বাংলাদেশের চা বাগানগুলির মালিকানা প্রধানত তিন ধরণের, ক) স্টারলিং কোম্পানি, খ) বাংলাদেশি কোম্পানি এবং গ) ব্যক্তি মালিকানা। যে সকল চা বাগানের মালিক ইউরোপীয় বিশেষত ব্রিটিশ তাদেরই বলা হয় স্টারলিং কোম্পানি। দেশীয় যে সকল কোম্পানি ১৯১৩ সালের কোম্পানি অ্যাক্ট দ্বারা গঠিত সেগুলো বাংলাদেশি কোম্পানি। স্টারলিং কোম্পানির চা বাগানগুলি আয়তন ও চা উৎপাদনের দিক থেকে বৃহত্তম (গড় আয়তন ১৬৪৮ একর)। এরপর রয়েছে বাংলাদেশি কোম্পানির মালিকানাধীন বাগান (গড় আয়তন ৬৬৯ একর) এবং সবচেয়ে ছোট বাগানগুলি মূলত ব্যক্তি মালিকানাধীন (গড় আয়তন ৩৪৩ একর)।
উনিশ শতকে ভারতে বাণিজ্যিক চা উৎপাদনের সময় প্রথমেই চীনা প্রজাতির চারা এবং চীনা শ্রমিকদের কথা বিবেচনা করা হয়। এর ফলে দেখা যায়, ৪২ হাজার চীনা প্রজাতির চারা কলকাতা বোটানিক্যাল গার্ডেনে উৎপাদন করে দার্জিলিং ও আসামে প্রেরণ করা হয়। তবে এই চারাগুলি অধিকাংশই পথিমধ্যে মারা যায় এবং বাকিগুলি মারা যায় রোপণের পর। এই বিপর্যয় বস্ত্তত ছিল আশীর্বাদস্বরূপ। কারণ এরপর থেকে বিশেষজ্ঞগণ চীনা প্রজাতির পরিবর্তে স্থানীয়ভাবে আবিষ্কৃত চা গাছের উন্নয়নে বেশি নজর দেন। এভাবেই স্থানীয় ও চীনা প্রজাতির সমন্বয়ে তৈরি শংকর প্রজাতির (ঐুনৎরফ ঞবধ) চা-এর পরিবর্তে দেশজ চা উৎপাদনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৮৫১ সালে ‘আসাম ব্রান্ড টি’ রাজকীয় অনুমোদন লাভ করে। সিলেটে ১৮৫৬ সালের ৪ জানুয়ারি দেশজ চা গাছ আবিষ্কৃত হয় এবং এতে ইউরোপীয় চা-কর এবং ব্রিটিশ প্রশাসকদের মধ্যে উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। তারা নিশ্চিত হন যে, শিক্ষা ও সংস্কৃতি এবং যোগাযোগের দিক থেকে সিলেটের মত একটি অগ্রসর এলাকায় চা উৎপাদন বাণিজ্যিক দিক থেকে লাভজনক হবে। সিলেটের তৎকালীন ম্যাজিট্রেট টি.পি লারকিন্স বঙ্গদেশের লেফটেন্যান্ট গভর্নরের কাছে লেখা এক রিপোর্টে উল্লেখ করেন যে, চাঁদখানি টিলায় প্রাকৃতিকভাবেই প্রচুর চা গাছ জন্মায় এবং এগুলির গুণাগুণ বিচারের জন্য নমুনা হিসেবে কিছু চা গাছ কলকাতাস্থ ভারতীয় কৃষি সমিতির (ওহফরধহ অমৎরপঁষঃঁৎব ঝড়পরবঃু) কাছে প্রেরণ করা হয়েছে। লারকিন্স বঙ্গদেশের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিকে অনুরোধ করেন যে, তিনি যেন দেশজ প্রজাতির চা গাছ আবিষ্কারক মোহাম্মদ ওয়ারিসকে ৫০ টাকা পুরস্কার প্রদান করেন। এভাবে একজন দেশিয় ব্যক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
প্রথম পর্বে বিদেশি কোম্পানিগুলির আধিপত্য উনিশ শতকের ষাটের দশককে বলা যায় চা শিল্প বিকাশের প্রথম পর্যায়। ব্রিটিশ শ্বেতাঙ্গদের কাছে চা শিল্পে বিনিয়োগ ছিল ক্যালিফোর্নিয়া গোল্ডরাশের (এড়ষফ জঁংয) সমতুল্য। অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্মকর্তা, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, পশু চিকিৎসক, জাহাজ চালক, রসায়নবিদ, দোকানদার, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাই চা শিল্পে বিনিয়োগ শুরু করেন। তবে অতিমাত্রায় বিনিয়োগের ফলে অচিরেই দেখা দেয় মহামন্দা। তবে এই মন্দা দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। সত্তরের দশকে বাণিজ্যিক উদ্যোগ হিসেবে চা শিল্প অনেকটা স্থিতি লাভ করে। আশির দশকে কোম্পানি ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বাগানগুলি ক্রয় করে নেয় এবং চা শিল্পে বিনিয়োগ হয় বিরাট অংকের পুঁজি।
সারণি ১ চা শিল্পে ইউরোপীয় কোম্পানি ও এজেন্সি হাউজের অবস্থান।
এজেন্সি হাউজের নাম জমির পরিমাণ (একর)
জেমস ফিনলে ২৬,৯৩৫
অক্টাভিয়াস স্টিল ১৪,৭৭৬
ম্যাকলিওড এন্ড কোম্পানি ৫৩৩৭
শ এবং ওয়ালেস ৪১৮০
বারলো এন্ড কোম্পানি ৩২৪১
প্ল্যান্টার্স স্টোরস এন্ড এজেন্সিস ৩০২৮
কিং হ্যামিলটন এন্ড কোম্পানি ২০৯৫
ডানকান ব্রাদার্স ১৮৪৮
ব্যারি এন্ড কোম্পানি ১৩১৫
উইলিয়ামসন এন্ড ম্যাগর ১২৮০
জে. ম্যাকিলিক্যান ১২১৯
ম্যাকনিল ৮৪৯
এন্ড্রু ইউল ৭৯৯
গ্রিন্ডলে ৬১৬
কিলবার্ন কোম্পানি ৪০০
ওয়েকার ৩২৭
ডব্লিউ. ক্রেসওয়েল ২৫৫
ন্যাশনাল এজেন্সি ২৩৭
মোট জমির পরিমাণ (একর) ৬৮,৭৩৭
বাংলাদেশের চা শিল্পের বিকাশে জেমস্ ফিনলে একটি উল্লেখযোগ্য নাম। ১৭৪৫ সালে গ্লাসগোতে তিনি এই কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর পুত্র কিরকম্যান ফিনলে এই কোম্পানির ব্যবসা আমেরিকা, ইউরোপ ও ভারতে বিস্তৃত করেন। ১৮৬১ সালে জন ম্যুর এই কোম্পানির অধিকাংশ শেয়ার কিনে নতুন মালিক হন এবং কোম্পানিটির নতুন নামকরণ হয় ফিনলে অ্যান্ড মুর। কিন্তু জনসমুক্ষে এটি জেমস ফিনলে হিসেবেই পরিচিতি লাভ করে। ১৮৮২ সালে জন মুর নর্থ সিলেট টি কোম্পানি এবং সাউথ সিলেট টি কোম্পানি নামে দুটি চা বাগান প্রতিষ্ঠা করেন। উনিশ শতকের আশির দশকে জেমস ফিনলে কোম্পানির মূলধন ছিল ৫৫ লক্ষ পাউন্ড। ফিনলে কোম্পানির চা বাগানের সিংহভাগই বর্তমানে বাংলাদেশের সিলেটে অবস্থিত। এ কোম্পানির কিছু বাগান আসাম, দক্ষিণ ভারত এবং শ্রীলংকায়ও রয়েছে। বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলংকায় ২ লক্ষ ৭০ হাজার একর জমিতে ফিনলে কোম্পানির চা বাগান ছিল এবং প্রায় ৭০ হাজার লোক এই কোম্পানিতে কর্মরত ছিল। উনিশ শতকের শেষ থেকে ফিনলে কোম্পানির চা বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, রাশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় প্রসারিত হয় এবং চা একটি অতি সুলভ ও সস্তা জনপ্রিয় পানীয় হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করে। ১৯১০ সালে প্রকাশিত টেইলর ম্যাপ অনুযায়ী সিলেটে ফিনলেসহ ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির চা বাগানের বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়। জেমস ফিনলে প্রথমত সরকার থেকে পতিত ভূমির ইজারা নেয়; দ্বিতীয়ত, ত্রিপুরার মহারাজার ভূমি অধিগ্রহণ করে এবং তৃতীয়ত, সাধারণ মানুষের জমি ক্রয় করে দক্ষিণ সিলেটের চা শিল্পে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।
উনিশ শতকের শেষে সিলেট চা শিল্পে অন্যতম প্রধান স্থান দখল করে নেয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, সিলেটে ১৮৯৩ সালে ২০৬,২৭,০০০ পাউন্ড চা উৎপাদিত হয় যা আসামের শীর্ষ চা উৎপাদনকারী জেলা শিবসাগরের সমান। ১৯০০ সাল পর্যন্ত উৎপাদনের এই ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত থাকে। ১৯০৪-০৫ সালে সিলেটে মোট ১২৩টি চা বাগান ছিল যার মধ্যে ১১০টি ছিল ইউরোপীয় মালিকানাধীন। ১৯১০ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, ৯৫ শতাংশ চা বাগানের মালিক ছিল বিদেশি এবং বাকি ৫ শতাংশের মালিকানা ছিল স্থানীয় উদ্যোক্তাদের নিয়ন্ত্রণে। ১৯২০ সালে স্থানীয়দের মালিকানা প্রায় ১০ শতাংশে উন্নীত হয়।
চা শিল্পে আরো অগ্রগতি উনিশ শতকের সত্তরের দশকে চা উৎপাদনের জন্য যাবতীয় যন্ত্রপাতি ব্রিটেন থেকে আমদানি করা হতো। প্রথমদিকে একটি প্রধান সংকট ছিল জ্বালানি সমস্যা যা মূলত বনজ কাঠ থেকে তৈরি চেরাকলের উপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে কয়লা ও তেল জ্বালানি হিসেবে ব্যবহূত হয়। জ্বালানি সমস্যার নিরসনের ফলে চা-এর উৎপাদন ও গুণগতমান বৃদ্ধি পায়। নববইয়ের দশকে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে-এর পূর্ণতা এবং নৌপথের বিস্তৃতি চা শিল্পের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় আধুনিকায়নের ফলে চা পরিবহণের খরচ ব্যাপকহারে হ্রাস পায়। জমির গুণগতমান নির্ণয়ের পরীক্ষার বিষয়েও বৈজ্ঞানিক সাফল্য আসে। হ্যারল্ড ম্যান নামক একজন ব্রিটিশ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করেন যে, সিলেটের টিলায় এবং অন্যান্য কিছু নির্ধারিত জমিতে উৎকৃষ্ট মানের চা উৎপাদন সম্ভব। চা শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় বৈজ্ঞানিক জ্ঞান এবং ব্যবস্থাপনা দক্ষতার জন্য বিদেশি উদ্যোক্তাগণ চা শিল্পে বরাবরই শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রেখেছে। তবে তাদের এই অর্জন এসেছে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সাথে দ্বিপাক্ষিক তথ্য বিনিময় এবং দেশজ জ্ঞানের সহায়তা নিয়ে।
সিলেটের দুজন বিখ্যাত আইনজীবী হরেন্দ্রচন্দ্র সিংহ এবং প্রমোদচন্দ্র দত্ত ওয়ার্কম্যান ব্রিচ অব কনটাক্ট নামে একটি গ্রন্থ লেখেন যেখানে চা শ্রমিক নিয়োগ সংক্রান্ত আইনের খুঁটিনাটি তুলে ধরা হয়। এসব আইনি তথ্যের মাধ্যমে দেশীয় ও ইউরোপীয় উভয় উদ্যোক্তারাই লাভবান হন। ১৯৩৩ সালে অবিনাশ চন্দ্র নামে একজন দেশীয় ম্যানেজার চায়ের চাষ এবং এ বিষয়ে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি নিয়ে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি দাবি করেন যে, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং স্থানীয় জ্ঞানের সমন্বয় ঘটেছে গ্রন্থটিতে যা উৎপাদনকারীদের জন্য সহায়ক হবে। দেশীয়দের মধ্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণি ছিল টিলা বাবুগণ যারা জমির গুণাগুণ পরীক্ষা এবং স্থানীয় আবহাওয়া সম্পর্কে ইউরোপীয় চা-করদের অবহিত করত। কিছু ক্ষেত্রে অনেক টিলাবাবুই নতুন বাগান প্রতিষ্ঠা করার পর ইউরোপীয়দের হাতে তুলে দিয়েছেন। যেমন দি নিউ সিলেট টি এস্টেটের প্রথম মালিক ছিলেন একজন বাবু। পুঁজিবাদী কায়দায় চা শিল্পের বিস্তারে দেশিয় ভদ্রলোক শ্রেণির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
চা শিল্পে দেশীয় উদ্যোক্তা এবং জয়েন্ট স্টক কোম্পানি ১৮৩৯ সালে ইউরোপীয়রা আসাম টি কোম্পানি গঠন করে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের ভদ্রলোক শ্রেণির সহযোগিতা নিয়ে। ১৮৭৬ সালে কাছাড় নেটিভ স্টক কোম্পানি গঠিত হয় শুধু সিলেটের পুঁজিপতিদের নিয়ে। এই কোম্পানি হচ্ছে আসাম এবং বঙ্গদেশের প্রথম দেশিয় চা কোম্পানি যার মালিক ছিলেন স্থানীয় উদ্যোক্তাগণ। সিলেটের একজন বিখ্যাত আইনজীবী মোশাররফ আলী তাঁর কতিপয় হিন্দু বন্ধুদের নিয়ে এই কোম্পানি গঠন করেন এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু আসাম সরকারের উচ্চপদস্থ আমলা যোগেশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রয়োজনীয় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেন। মোশাররফ আলীর পুত্র মনোয়ার আলী আসাম আইনসভার সদস্য ও আসাম সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পূর্বপর্যন্ত এই কোম্পানির লভ্যাংশ মোশাররফ আলীর উত্তরাধিকারীগণ গ্রহণ করেছেন। ১৮৮০ সালে গঠিত ভারত সমিতি লিমিটেড নামে আরেকটি কোম্পানি কালিনগর চা বাগান পরিচালনা করত। ভারত সমিতির অনুমোদিত মূলধন ছিল ৫ লক্ষ রুপি এবং পরিশোধিত মূলধন ছিল ১,০০,৪৭৫ রুপি। ১৮৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ইন্দেশ্বর টি অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানির মালিকানায় পরিচালিত হতো ইন্দেশ্বর চা বাগান। এই কোম্পানির অনুমোদিত মূলধন ছিল ১ লক্ষ রুপি এবং পরিশোধিত মূলধন ছিল ৮৮,৭৮৫ রুপি। স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, দেশিয় কোম্পানিগুলির আর্থিক সামর্থ্য ছিল কম এবং এদের নিজস্ব কোনো কারখানা ছিল না। চা প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য তারা প্রতিবেশী ইউরোপীয়দের কারখানায় প্রেরণ করত। এভাবে পরস্পরের মধ্যে সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ইউরোপীয় চা করগণ স্থানীয় জমিদারদের কাছ থেকে জমি ক্রয় করে অনেক বাগান প্রতিষ্ঠা করেন। যেমন জমিদার ব্রজনাথ চৌধুরী সিলেটের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্কটিশ কোম্পানি ডানকান ব্রাদার্সকে তার জমিদারির এক বিরাট অংশ চা বাগানের জন্য বন্দোবস্ত দেন। বিনিময়ে তিনি ডানকান ব্রাদার্সের সহায়তায় পার্শ্ববর্তী ত্রিপুরা রাজ্যে ১,০৬৫ একর জমিতে মহাবীর টি এস্টেট নামে একটি চা বাগান প্রতিষ্ঠা করেন। এই চা বাগানটি ত্রিপুরার মহারাজা বীরবিক্রম মানিক্য বাহাদুরের নামে নামকরণ করা হয়েছিল।
১৯১১ সালে আসামের প্রথম দেশিয় মন্ত্রী খান বাহাদুর সৈয়দ আব্দুল মজিদ সিলেটে নেতৃস্থানীয় হিন্দুদের সহায়তায় প্রতিষ্ঠা করেন অল ইন্ডিয়া টি কোম্পানি যার অনুমিাদিত মূলধন ছিল ১০ লক্ষ রুপি এবং পরিশোধিত মূলধন ছিল ৭,১০,৯৮৫ রুপি। অচ্যুতচরণ চৌধুরী ১৯১০ সালে তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, সে সময় ১০টি চা বাগানের মালিক ছিলেন দেশিয় উদ্যোক্তাগণ। সিলেটের জনৈক জমিদার নবাব আলী আমজাদ খান রঙ্গির ছড়া নামে একটি চা বাগান প্রতিষ্ঠা করেন। এটি দেশিয় মালিকানাধীন চা বাগানের মধ্যে সর্ববৃহৎ। অনেক উচ্চ উপাধিধারী ও সম্ভ্রান্তবংশীয় মুসলমান চা শিল্পে আগ্রহ দেখিয়েছেন। ১৯০৪ সালে মুহম্মদ বখত মজুমদার, করিম বখ্শ, গোলাম রাববানী, আব্দুল মজিদ কাপ্তান মিয়া যৌথভাবে ব্রাহ্মণছড়া চা বাগানের মালিক ছিলেন। জমিদার ও রাজনৈতিক এবং কেন্দ্রীয় আইনসভার সদস্য আব্দুর রশিদ চৌধুরী এবং তাঁর পুত্র আমিনুর রশিদ চৌধুরী সিলেটে চা বাগান প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায় সুনাম অর্জন করেছেন এবং তাদের প্রতিষ্ঠিত চা বাগানগুলি এখনও চালু আছে।
১৯২১-২২ সালে আসাম প্রদেশের চা শিল্পে সর্বমোট ২৯টি দেশিয় জয়েন্ট স্টক কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন লাভ করে যার মধ্যে ২৩টি ছিল সিলেটে, ৩টি কাছাড়ে এবং বাকি ৩টি আসামের অন্যান্য জেলায় রেজিস্ট্রিকৃত। ব্রিটিশ আমলা ও চা করদের আত্মজীবনী থেকে জানা যায় যে, আসাম প্রদেশের মধ্যে ৯০ শতাংশ ইউরোপীয়দের ক্লাব ছিল মূলত সিলেট শহর এবং এ জেলার চা বাগানগুলিতে। এতে প্রতীয়মান হয় যে, সমগ্র আসাম প্রদেশে চা শিল্পের কেন্দ্রবিন্দু ছিল সিলেট। ওই সময় আসামে ১১৪টি জয়েন্ট স্টক কোম্পানি নিবন্ধিত হয়েছিল যার মধ্যে চা কোম্পানি ছিল এক তৃতীয়াংশ। চা কোম্পনিগুলির মূলধন ছিল সবচেয়ে বেশি। এছাড়া কলকাতার বাঙালি ও মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ীরা সিলেটের দেশিয় চা-কর এবং স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সহায়তায় একটি বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয় চা শিল্পের বিপণন এবং বাজারজাতকরণের লক্ষ্যে কলকাতা কেন্দ্রিক বেশকিছু দেশিয় এজেন্সি হাউজ।
পাকিস্তান আমল চা শিল্প ১৯৪৭ সালের পর এক নতুন যুগে প্রবেশ করে। এর পর থেকে ক্রমান্বয়ে মালিকানায় এক উল্লেখযোগ্য অংশ পশ্চিম পাকিস্তানি পুঁজিপতি শ্রেণির হাতে চলে যায়। এর অন্যতম প্রধান কারণ, ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর পূর্ববাংলা এবং সিলেটের অনেক হিন্দু জমিদার ও পেশাজীবী সিলেট পরিত্যাগ করে ভারতে অভিবাসন নেন। তাঁদের অনেকেই পুঁজি বিনিয়োগ করেছিলেন চা শিল্পে। তাঁদের প্রস্থান এক ধরনের সংকট সৃষ্টি করে। এই শূণ্যতা পূরণে যারা এগিয়ে আসেন তাঁদের অনেকেই ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি পুঁজিপতি। এ প্রক্রিয়ায় তাঁরা কেন্দ্রীয় সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। ১৯৬৬ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, ১১৪টি চা বাগানের মধ্যে ৫৬টির মালিক পশ্চিম পাকিস্তানি পুঁজিপতি, ৪৭টির মালিক ইউরোপীয় এবং মাত্র ১১টির মালিক বাঙালি উদ্যোক্তা। ১৯৭০ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, ১৬২টি চা বাগানের মধ্যে ৭৪টির মালিক পশ্চিম পাকিস্তানি উদ্যোক্তা।
বাংলাদেশ আমল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় চা শিল্পের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। এ শিল্পকে পূর্বের অবস্থায় পুনঃস্থাপিত করার জন্য ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার একটি কমিটি গঠন করে। কমিটির প্রধান সুপারিশ ছিল চা শিল্পে উৎপাদন বাড়ানোর পদক্ষেপ গ্রহণ, উৎপাদন খরচ কমানো এবং বিপণন প্রক্রিয়া আরো শক্তিশালী করা।
চা শিল্পে পাকিস্তান আমলের ন্যায় বাংলাদেশ আমলের প্রথম তিন দশক অর্থাৎ ১৯৭০, ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে ব্রিটিশ/স্কটিশ কোম্পানিগুলির আধিপত্য অব্যাহত ছিল। কারণ বিদেশি স্টারলিং কোম্পানির বাগানগুলো আয়তনের দিক থেকে ছিল দেশিয় বাগানের তিনগুণ এবং এসব বাগানে একর প্রতি উৎপাদন তুলনামূলকভাবে বেশি। বর্তমানে বাংলাদেশে চা বাগানের সংখ্যা ১৬২টি। এর মধ্যে ১৩৫টি সিলেট বিভাগে, ২৩টি চট্টগ্রামে এবং ৪টি নবগঠিত রংপুর বিভাগে। ২০০৮ সালের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ বাৎসরিক ৫৯ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন করে। ২০০০ সালে বাংলাদেশ বিশ্বের ৩০টি চা উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে ৯ম চা উৎপাদনকারী দেশ ছিল, কিন্তু ২০০৮ সালে বাংলাদেশ ১১তম স্থানে নেমে আসে। তবে ২০১০ সালে চা উৎপাদন কিছুটা বৃদ্ধি পায়। চা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানি দ্রব্য যা দীর্ঘকাল থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে দেশে একটি বড় অভ্যন্তরীণ বাজার তৈরি হয়েছে। ফলে রপ্তানির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে কমছে। ২০০৯ সালে চা রপ্তানি প্রায় ৬৮% কমে ২.৫৩ মিলিয়ন কেজিতে নেমে আসে। অর্থাৎ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে প্রতিবছর প্রয়োজন ৫৭ লক্ষ কেজি চা। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ ৪০ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন করে এবং রপ্তানি করে ৩১ মিলিয়ন কেজি। বর্তমানে উৎপাদন করে প্রায় ৬০ মিলিয়ন কেজি এবং রপ্তানি করে মাত্র ৩ মিলিয়ন কেজি।
১৯৪৭ সালের পূর্বে চা ক্রয়বিক্রয় বা নিলামের মূল কেন্দ্র ছিল লন্ডন। ভারত বিভাগের পর ব্রিটিশ চা করগণ এবং পুঁজিপতিরা লন্ডনেই চা-এর নিলাম পছন্দ করতেন। কিন্তু ভারত কিছুদিনের মধ্যে কলকাতায় চা-এর নিলাম শুরু করলেও পাকিস্তান প্রথমে লন্ডনে এবং পরে চট্টগ্রামে চা-এর নিলামের আয়োজন করত। নিলামে অংশগ্রহণকারী এজেন্সিগুলি চা উৎপাদনকারীদের ব্রোকার সেবা এবং অন্যান্য সুবিধাদি প্রদান করে। এরা ঐতিহ্যগতভাবে উৎপাদনকারীকে অর্থপ্রদান থেকে শুরু করে ব্যাংক ঋণ এবং এল.সি খোলার সুবিধাদি প্রদান করে আসছে। এছাড়াও ব্রোকার হাউজগুলি বিশ্ববাজারে চা-এর বাজারকে স্থিতিশীল ও অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক করার ক্ষেত্রে কাজ করে থাকে। চা-এর গুণাগুণ পরীক্ষা, ক্যাটালগিং করা, স্ট্যাপলিং, মূল্যায়ন ও পরিসংখ্যান সরবরাহের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে থাকে ব্রোকার হাউজগুলি। অন্যদিকে ব্যাংকারগণ শিপিং ডকুমেন্টস দেখে চা উৎপাদনকারীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করে থাকে।
চা শিল্পে কর্মসংস্থান চা শিল্পে প্রায় দেড় লক্ষ লোক কর্মরত আছে। এটি একটি শ্রমঘন ও কৃষিভিত্তিক শিল্প বিধায় চা উৎপাদনের জন্য বিপুল শ্রমিকের প্রয়োজন। বিশ শতকের সত্তরের দশকের শুরুতে চা শিল্পে ১ লক্ষ ২০ হাজার পুরুষ ও নারী শ্রমিক নিয়োজিত ছিল এবং তাদের উপর নির্ভরশীল ছিল ৩ লক্ষ ৫০ হাজার পোষ্য। বাংলাদেশের চা শ্রমিকদের অধিকাংশই ভারত থেকে আগত, কিন্তু বর্তমানে তারা প্রায় সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। মধ্য উনিশ শতকে এদের পূর্বপুরুষ মূলত ভারতের ছোট নাগপুর-ঝাড়খন্ড অঞ্চল থেকে এদেশে আগমন করে। চা-শ্রমিকদের পূর্বপুরুষদের অনেকে এসেছে বিহার, ঊড়িষ্যা, পশ্চিমবঙ্গ, ছত্রিশগড় অঞ্চল থেকে। কুলি নামে পরিচিত চা-শ্রমিকরা স্থায়ীভাবে নির্মিত চা-কুলি লাইনের অপরিসর গৃহে বসবাস করছে। বংশানুক্রমিক চা-শ্রমিক সমাজেও এখন কিছুটা বেকার সমস্যা দেখা দিয়েছে। [আশফাক হোসেন]
চায়ের ইতিহাস অনেক পুরোনো হলেও বাংলাদেশে এর আবির্ভাব ঘটে ১৮ এর শতকে। বৃটিশরা ভালো করেই বুঝতে পেরেছিল যে এদেশের মানুষকে দিয়ে এই জঙ্গল পরিষ্কার করে চা বাগান তৈরি করা সম্ভব নয়। তাই ‘মাটি খুড়লে স্বর্ণ পাওয়া যায়’ এমন প্রলোভন দেখিয়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে লোকজন নিয়ে আসে বৃটিশরা।
গ্রন্থপঞ্জি James Finlay Papers, UGD91/8/3/6/2/16; H Cottam, Tea Cultivation in Assam, Colombo, 1877; Harold H Mann, Tea Soils of Cachar and Sylhet, Calcutta, 1903; Avinas Chandra Dutta, Handbook of Tea Manufacture, Habiganj, 1933; Anonymous, James Finlay and Company Limited: manufacturers and East India merchants, 1750-1950, Glasgow, 1951; Proceedings of the Tea Conference held at Sylhet on 26 and 27 January 1949, Ministry of Commerce, Government of Pakistan, 1949; GP Stewart, The Rough and Smooth (autobiography); Bangladeshiyo Cha Sangsad, Annual Report, Srimongal, 1984.
Leave a Reply