আসাদ উদ্দিন আহমদ: পুণ্যভূমি সিলেটের মাটি ও মানুষের সবচেয়ে কাছের মানুষ বলতে যে চেহারা সবার চোখে ভেসে ওঠে তিনি আর আমাদের মাঝে নেই। সিলেট শহরে দীর্ঘ সময় ধরে আওয়ামী লীগ নামক বিশাল দলটির সঙ্গে যার নাম জুড়ে আছে সেই বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের চলে যাওয়ার পর নগরে নেমেছে শোকের ছায়া। অনেকে প্রকাশ্যে কাঁদছেন আবার অনেকে নিভৃতে। সিলেট তার রাজনীতির বিচরণ ভূমি হলেও জাতীয় নেতা হয়ে উঠেছিলেন তিনি সহজেই। তাই শুধু সিলেটবাসী বললে ভুল হবে, প্রকৃতপক্ষে, তার বিদায়ে কেঁদেছে পুরো দেশ।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে যখন পুরো দেশ তথা বিশ্ববাসী স্তব্ধ, তখন গত রোববার (১৪ জুন) দিবাগত রাত পৌনে ৩ টার সময়ে যে খবরটি আমরা পেলাম তা সিলেট এবং দেশের মানুষসহ ব্যক্তি আমাকে কিভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে তা লিখে বা বলে বুঝানো যাবে না।
অনেকেই কামরান ভাইয়ের সঙ্গে আমার দীর্ঘ পথচলার স্মৃতিচারণ করতে বলছেন। কিন্তু গত ২/৩ দিন ধরে আমি জানি, লিখতে বসলে আমার কলম কোনো শব্দ যোগাবে না। দীর্ঘদিনের পথ চলায় সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কামরান ভাই এবং আমাকে অনেক কিছু লিখতে হয়েছে একসঙ্গে। অনেক সাংগঠনিক প্রতিবেদন, দলের খবর, প্রেস রিলিজ, পোস্টার ইত্যাদি দু’জন মিলে লিখেছি। আবার দীর্ঘ ৮ বছর সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক থাকার সময় স্বাক্ষর করতে হয়েছে অনেক কমিটির প্যাডে ও দলীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাগজে।
সর্বশেষ যখন গতমাসের ১৫ মে শুক্রবার নগরীর ১৮নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের ত্রাণ বিতরণ করতে যাই তখন তিনি আর আমি এক জায়গায় একসঙ্গে বসে ছিলাম। আমাকে জানালেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর প্রথম থেকেই আমার কাজ তিনি দেখছেন এবং আমাকে নিরাপদে থেকে এইসব কার্যক্রম চালিয়ে যেতে বললেন। কামরান ভাইয়ের সঙ্গে আমার শেষ রাজনৈতিক কোনো অনুষ্ঠান ছিল ১৮ মার্চ মুজিববর্ষের একটি অনুষ্ঠান। সেখানেও আমরা পাশাপাশি বসেছিলাম। এটিই তার সিলেটে শেষ কোন রাজনৈতিক অনুষ্ঠান ছিলো। এর আগে গত ১১ মে সন্ধ্যার পর জেলা আওয়ামী লীগের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক ইফতেখার হোসেন শামীম ভাইয়ের ৮ম মৃত্যুবার্ষিকীতে কামরান ভাই এবং আমাকে নিয়ে একটি অনলাইন মিডিয়া লাইভ শো আয়োজন করে। সেখানে আমরা শামীম ভাইকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করি। কিন্তু তখনও কী ভেবেছিলাম কিছুদিন পরই আমার কামরান ভাইকে নিয়ে এরকম স্মৃতিচারণ করতে কলম ধরতে হবে?
এই কয়দিনে দেশ এবং দেশের বাইরে থেকে বহু ফোনকল এসেছে আমার কাছে । অনেকে বাকরুদ্ধ। আবার অনেকেই মেনে নিতে পারছেন না তাদের প্রিয়নেতার এই অকালে চলে চাওয়া।
গত ৫ই জুন শুক্রবার যখন এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ থেকে ‘কোভিড-১৯’ টেস্টের ফলাফল ‘পজিটিভ’ আসে তখন আমার সঙ্গে কামরান ভাইয়ের কথা হয় ফোনে। আমাকে জানালেন, নিজ বাসায় আইসোলেশনে থেকে চিকিৎসা নেবেন তিনি। সেই সঙ্গে মনে করিয়ে দিলেন যে তার ছেলে চিকিৎসক তাই চিকিৎসা নিতেও অসুবিধা হবে না। তার ছেলের প্রতি ছিল তার বিশেষ আস্থা। পরবর্তীতে তার শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা দেখা দিলে সিলেট শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু এর একদিন পরেই তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ঢাকায় পাঠানোর উদ্যোগ নেয় তার পরিবার।
আমরাও হুইল চেয়ারে অক্সিজেনসহ অ্যাম্বুলেন্সে কামরান ভাইকে তুলে দিলাম। হাত ধরে হুইল চেয়ার থেকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেওয়ার সময় আমাকে বললেন, ‘দীর্ঘ চলার পথে হয়ত অনেক ভুল-ত্রুটি হয়েছে,আমাকে ক্ষমা করে দিবেন’, তার প্রতি উত্তরে আমিও তাকে একই কথা বলি। তারপর তিনি সিলেটবাসীর প্রতি তার জন্য দোয়া চাইতে বললেন আমাকে। এটিই যে আমাদের শেষ কথা বা শেষ দেখা হবে সে সময় বুঝতে পারিনি।
উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরামর্শে তাকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি করা হয় ওইদিনই সন্ধ্যার দিকে। সেদিন থেকে তার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই তার ছেলে অথবা ভাইয়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছে, তারা জানিয়েছেন সার্বিক অবস্থা।
এর মধ্যে প্লাজমা থেরাপি দিতে হবে বলে ডাক্তাররা জানালেন। এই খবর শুনে তখন অনেকে আমাকে ফোন দিয়ে জানালেন যে তাদের এই প্রিয় নেতাকে তারা ‘প্লাজমা’ দিতে চান। আমি তাদেরকে শিপলুর (কামরান ভাইয়ের বড় ছেলে) ফোন নাম্বার দিয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়েছিলাম।
প্রতিদিনই শারীরিক অবস্থা উন্নতি হচ্ছে জেনে একটি প্রশান্তি কাজ করত আমাদের মধ্যে। এরমধ্যে অনেকেই কামরান ভাইয়ের খবরা-খবর নিতে ফোন দিতেন আমাকে। আমাদের দলের কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে তৃনমূলের কর্মীরাও সব সময়ই খোঁজ নিয়েছেন তাদের প্রিয় নেতার।
২০১১ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা কামরান ভাইকে সভাপতি এবং আমাকে সাধারণ সম্পাদক করে সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটি দেন। সেই থেকে প্রতিটি সময় কামরান ভাই এবং আমি কিভাবে সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগকে সু-সংগঠিত করা যায় সেই লক্ষ্যে কাজ করেছি। সময়ের প্রয়োজনে দলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আমাদের দু’জনকেই নিতে হয়েছে। দলের অনেক কঠিন সময় আমরা একসঙ্গে পার করেছি। কখনও কোনো বিষয়ে মতানৈক্য হলেও আমরা একজন আরেকজনকে সব সময় ছাড় দিতাম। যদিও আমি বয়সে তার ছোট ছিলাম কিন্তু বিভিন্ন প্রোগ্রামে আমাকে ‘আসাদ ভাই’ বলেই সম্বোধন করতেন তিনি। মহানগর আওয়ামী লীগ যেকোনো সমস্যায় পড়লেই তার সঙ্গে যোগাযোগ হলে তিনি সমাধান বলে দিতেন। বেশি জটিল সমস্যা হলে বলতেন ‘আমরা বসে ব্যাপারটা দেখছি’। সমাধানও হয়ে যেত। তার সঙ্গে একই কমিটিতে কাজ করতে করতে অনেক কিছুই শেখা হয়েছে। কিভাবে সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে কাজ করা যায় তা কামরান ভাই আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন।
কামরান ভাইয়ের একটি অন্যতম গুন ছিল সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে কাজ করার মানসিকতা। কাউকে দূরে ঠেলে দিতেন না তিনি। সেজন্যই তিনি সিলেটের গণমানুষের নেতা হয়ে উঠেছিলেন। দলের কঠিন সময়ে কামরান ভাইয়ের যে নেতৃত্ব ছিল তার গুরুত্ব বলে বা লিখে শেষ করা যাবে না। সিলেট আওয়ামী লীগ শক্তিশালীকরনে তার অবদান চীরদিন স্মরণ করা হবে। কামরান ভাই এবং আমি একসঙ্গে নেত্রী শেখ হাসিনার জনসভা, দলের প্রতিনিধি সভা, সম্মেলন, মিছিল, মানবন্ধন, প্রতিবাদ সভা ইত্যাদি প্রোগ্রাম আয়োজন করেছি। সিলেটে প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে কামরান ভাই জড়িত ছিলেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন।
সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমি আমার কমিটির সভাপতির কাছ থেকে আপন বড় ভাইয়ের মত যে সাহায্য পেয়েছি। অনেক সময় আমি কিছু বললেও মানা করতেন না, এই সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণের জন্যই অনেকেই বোধহয় আমাদেরকে ‘আসাদ-কামরান’ জুটি হিসেবে দেখতেন। কিন্তু আমি কামরান ভাইকে দেখতাম আমার এক রাজনৈতিক অভিভাবক হিসেবে। সহযোগিতার এই মানসিকতা কামরান ভাইকে বিশাল করে তুলেছে। কামরান ভাই সিলেটে আমাদের জন্য এক বটবৃক্ষ ছিলেন। দলের নেতাকর্মী বা সিলেটবাসীরা যখনই কোন সমস্যায় পড়তেন তাদের এক নিশ্চিত আশা-ভরসার স্থান ছিলো কামরান নামক বিশাল বটবৃক্ষ।
রাজনীতি করার সুবাদে বদর উদ্দিন আহমদ কামরানকে যতটা না চিনতে পেরেছিলাম এর থেকেও বেশি ব্যক্তি কামরানকে আমি জানতাম। গান, কবিতা ভালবাসেন এমন সদা হাস্যোজ্জ্বল এক মানুষ ছিলেন তিনি। দলের অনেক জনসভায়ও গান ধরেছিলেন তিনি। দিন-রাত নগরের অলিতে-গলিতে চষে বেড়ানোই ছিল তার কাজ।
তার আচরণে, ব্যবহারে সিলেটের মানুষ তাকে মনের মণিকোঠায় জায়গা দিয়েছিল বলেই তিনি সবার কাছে ‘মেয়র সাব’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র থাকা অবস্থায় তার কাছে গিয়ে সাহায্য না পেয়ে আসা লোক পাওয়া দুষ্কর। আবার তিনি মেয়র না থাকা অবস্থায়ও তার ‘ছড়ারপাড়ার বাসার দরজা সব সময় সবার জন্যই উন্মুক্ত থেকেছে। তার বাসার সামনে কোন ফটক নেই। যাতে নগরবাসী চাইলেই তার বাসায় ঢুকে যেতে পারেন। প্রায় সময়ই দলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আমরা সেখানে বসেই নিতাম। সময়ের এই কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ে ‘কামরান ভাই হীন শূন্য বাসা’ হয়ে যাবে তা কখনও ভাবিনি।
শেষ শ্রদ্ধা জানাতে গত সোমবার তার মরদেহের উপর ফুল রাখতে গিয়ে আরেকবার ধাক্কা খেলাম। বুক ফেটে গেলো হঠাৎ এক কান্নার ধাক্কায়। তখন আমার মনে হয়েছে হৃদয়ের রক্তক্ষরণ এবং অশ্রুভেজা এই হাজারও মানুষের উপস্থিতি দেখে হয়ত কামরান ভাই তার চীর চেনা হাসি হাসছেন। এমন মানুষের চিরবিদায় কী বললেই দেওয়া যায়…? কামরান ভাইয়ের প্রানহীন শরীর হয়ত আমরা দাফন করেছি কিন্তু তার স্মৃতি কি কখনও বিদায় হবে সিলেটবাসীর হৃদয় থেকে?
শুধু সিলেটবাসীই বা কেন? কামরান ভাই এমন এক নেতা ছিলেন যিনি স্থানীয় পর্যায়ে রাজনীতি করেও সারা দেশবাসীর কাছে জাতীয় নেতার মতই স্বীকৃতি পেয়েছেন।
ইসলাম ধর্মমতে মহামারিতে যাদের মৃত্যু হয় তারা শহীদের মর্যাদা পায়। আমি সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি যেনো কামরান ভাইকে তিনি জান্নাত দান করেন। আর সেই সঙ্গে সিলেটবাসীসহ তার পরিবারকে এই আকস্মিক শোক সইবার শক্তি দেন।
পুনশ্চ: মরহুম কামরান ভাই এর স্ত্রী, সিলেট মহানগর মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসমা কামরান ভাবি করোনায় আক্রান্ত আগে থেকেই। আমি তার দ্রুত সুস্থতা কামনা করি। মানসিক ভাবে কামরান ভাইকে হারিয়ে আমরা সবাই বিধ্বস্ত, এই সময়ে তার ছেলেসহ পরিবারের সবাইকে শোক কাটিয়ে উঠার শক্তি যেন আল্লাহ দেন সেই দোয়া করি।
Leave a Reply