কমলগঞ্জ প্রতিনিধি ::
শোয়েব এলাহী, মূখ ও বধির। মানে কথা বলতে পারেন না, আবার কানেও শুনেন না। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শত্রুপক্ষের মর্টার বিষ্ফোরণের প্রচন্ড শব্দে শোয়েব এলাহীর কান ফেটে যায়। সে সময় মাত্র দশ মাসের শিশু শোয়েব ভারতে শরণার্থী হিসেবে বসবাসরত তার মায়ের কোলে ছিলেন। তার বাবা ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে গিয়ে শরণার্থী বাঙালীদের রেশন সরবরাহ করতেন ও পাক হানাদারদের গতিবিধি গোপনে পর্যবেক্ষণ করে মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য দিতেন। মূলত পাক হানাদাররা শোয়েব এলাহীর মাকে লক্ষ্য করে মর্টার ছুঁড়ছিলো। ভাগ্যক্রমে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে তাদের অদুরে পড়ে মর্টার বিষ্ফোরিত হয়।সে থেকে আজ ৫০ বছর ধরে মূক ও বধির জীবন কাটাচ্ছেন শোয়েব এলাহী।
কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান উপজেলা শ্রমিকলীগের সভাপতি প্রয়াত এম,এ, সবুর ও শামছুন নাহারের ২য় সন্তান শোয়েব এলাহী।যখন যুদ্ধের দামামায় চারদিক সরগরম। রাজনীতিবিদ বাবা এম,এ,সবুর মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করছেন।কমলা খাঁন, কুতুব খাঁন, চেরাগ আলীসহ এলাকার অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে উত্তরভাগস্থ নিজের বাড়ীর বৈঠকখানায় গোপন সভা করে শলা পরামর্শ করতেন। মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকাররা রাতের আঁধারে সে বাড়ীতে আগুন লাগিয়ে দিলো।এলাকার সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন আতংকিত হয়ে পড়লো।এম,এ,সবুর কয়েকটি হিন্দু পরিবারকে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের হালাহালি শহরে পৌঁছে দিলেন। সাথে তার স্ত্রী শামছুন নাহার, আড়াই বছরের শিশু কন্যা ইশরাত জাহান বীথি ও ৯ মাসের শিশুপূত্র শোয়েব এলাহী। তারাও আশ্রয় নিলেন ভারতের থানাবাজার এলাকার পারকুল গ্রামে এক হিন্দু বাড়ীতে।
শোয়েব এলাহীর মা শামছুন নাহার জানান, তাদেরকে জনৈক নগেন্দ্র দেবের বাড়ীতে রেখে স্বামী এম,এ,সবুর বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সুসংগঠিত করা,ধলাই সীমান্ত পেরিয়ে তাদেরকে ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে পৌঁছে দেওয়া এবং পাকিস্তানী সৈন্যদের গতিবিধি গোপনে পর্যবেক্ষণ করে মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য সরবরাহের কাজে ব্যস্ত হযে গেলেন। এছ্াড়া তৎকালীন এম,এন,এ মুক্তিযুদ্ধে চার নম্বর সেক্টরের ডেপুটি কমান্ডার মোহাম্মদ ইলিয়াসকে নিয়ে ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে শরণার্থীদের রেশন ও রসদ সরবরাহ করতেন।
তখন ছিলো এপ্রিল মাসের কোন এক দুপুর। বাড়ীতে বৃদ্ধ শ্বশুর একা রয়েছেন। এর মধ্যে খবর এসেছে রাজাকাররা জমির পাকা ধান কেটে নিয়েছে। স্বদেশ আর নিজের বাড়ীর চিন্তায় অস্থির শামছুন নাহার শোয়েব এলাহীকে কোলে করে নগেন্দ্র দেবের বাড়ীর উঠানে পায়চারি করছিলেন। হঠাৎ অদুরে হেলমেট মাথায় জলপাই রঙের ইউনিফর্ম পরা কয়েকজন সৈন্য চেেেখ পড়লো। কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই আকাশ ফাঁটানো শব্দে একটি মর্টার এসে বিষ্ফোরিত হলো শামছুন নাহারের পায়ের কাছে। ছেলেকে কোলে নিয়েই দৌড়ে পালালেন বাড়ীর আড়ালে। পরদিনই বাড়ী বদল করে চলে গেলেন হালাহালি গ্রমের শরফ উদ্দিনের বাড়ীতে।কিন্তু শোয়েবকে ডাকলে আর সাড়া দেয় না। অনেক ডাক্তার দেখালেন। কোন লাভ হয়নি।মাসের পর মাস অপেক্ষা করলেন। সন্তানের মুখ থেকে আর মা ডাকটি শুনতে পেলেন না। ডাকলেও আর সাড়া মিলছে না। ইশারাতে চলছে বাক্য বিনিময়। সবাই বললেন, মর্টারের প্রচন্ড শব্দে শিশুটির কান ফেটে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে মায়ের চোখের জলও শুকিয়ে গেলো। দেশ স্বাধীন হলো। কিন্তু মুখের ভাষা ফিরে পেলো না মায়ের কোলের সে নিষ্পাপ শিশু। সে থেকে আজ অবধি মূক ও বধির হয়ে জীবন কাটাচ্ছেন আটচল্লিশ বছরের যুবক শোয়েব এলাহী। সিলেট শেখঘাট মূক ও বধির বিদ্যালয়সহ ঢাকা ও ফরিদপুরের বিভিন্ন মূক ও বধির বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন। খুব ভালো ছবি আঁকতে পারেন। জীবিকার তাগিদে এখন গাজীপুরের কোনাবাড়ী এলাকায় একটি গার্মেন্ট কারখানায় সামান্য বেতনে কাজ করছেন। এক কন্যা সন্তানের জনক শোয়েব এলাহীর স্ত্রী পারবীন বেগমও জন্ম থেকেই মূক ও বধির।
আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ গড়ার পেছনে শোয়েব এলাহীর অবদান কি একেবারেই নগন্য ? এ উত্তর কে দেবে ?#
caller_get_posts is deprecated. Use ignore_sticky_posts instead. in /home/eibela12/public_html/wp-includes/functions.php on line 6121caller_get_posts is deprecated. Use ignore_sticky_posts instead. in /home/eibela12/public_html/wp-includes/functions.php on line 6121
Leave a Reply