এইবেলা, বড়লেখা :: কঠোর পরিশ্রম, ধৈর্য্য, সাহস আর একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে চলা সমাজের অনেক নারীই জীবন সংগ্রামে বিজয়ী হয়েছেন, প্রতিষ্ঠালাভ করেছেন। কিন্তু এদের প্রতিষ্ঠা লাভের পেছনের দুর্বিসহ দিনগুলোর কথা অনেকেই জানেন না।
বড়লেখা উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা সৌমিত্র কর্মকার ২০২৩ সালের জয়িতা অন্বেষণে এমন চারজন নারীকে খুঁজে এনেছেন, যারা কঠিন প্রতিকুলতায়ও এগিয়ে গেছেন তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে। অর্থনৈতিক, শিক্ষা ও চাকুরী, সংসার ও নারী নির্যাতনের বিভীষিকা মূছে ফেলে ঘুরে দাঁড়িয়ে পৌঁছেছেন কাঙ্খিত লক্ষ্যে। উপজেলা প্রশাসন ও মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর গত ৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়া দিবসে তাদের হাতে তুলে দিয়েছে সম্মাননা সনদ ও ক্রেষ্ট। এরা হলেন আত্ম প্রত্যয়ী উদ্যমী নারী মালেমহান দেবী, আনোয়ারা বেগম, শিল্পী বেগম ও প্রিয়া চনু।
সফল জননী আনোয়ারা বেগম : স্বামী ছিলেন বড়লেখার তেলিমেলি গ্রামের এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। তার সামান্য আয়ে স্ত্রী, ছয় মেয়েসহ এতবড় সংসার কিভাবে চালাবেন ভাবতেই শিউড়ে উঠেন। কিভাবে তিনি তার (ছয়) সন্তানকে মানুষ করবেন? অভাব অনটনের কারণে বড় দুই ছেলে ঠিকমত লেখাপড়া করতে পারেনি। স্বামী প্যারালাইজড রুগী হওয়ায় জীবিকার তাগিদে অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থানে তাকে যেতে হতো। সেখানে মেয়েদের উচ্চপদে চাকুরী, শিক্ষকতা, মানুষের সাথে ভালো আচার-আচরণ, আন্তরিকভাবে জনসেবা দেওয়া দেখে স্বপ্ন দেখতেন তার মেয়েরাও যদি লেখাপড়া করে এভাবে বড় পদে চাকুরী করতে পারতো তবে কতই না ভাল লাগতো। সেখান থেকেই উদ্বুদ্ধ নিজেই অঙ্গীকার করেন মহাকষ্ট হলেও তাদের ভালভাবে লেখাপড়া করাবেন। ছেলেমেয়েদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য তিনি স্বামীর পাশাপাশি যখন যে কাজ পেয়েছেন তা-ই করেছেন। দৃঢ় মনোবল আর অভিষ্ট লক্ষ্যের কাছে দারিদ্রতা হার মেনেছে। তিনি তার ছেলেমেয়েদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে স্বক্ষেত্রে তাদের করেছেন প্রতিষ্ঠিত। আনোয়ারা বেগমের বড় ছেলে মো. আব্দুল কাইয়ুম সফল ফার্নিচার ব্যবসায়ী। মেজো ছেলে আব্দুল আহাদ কাতার প্রবাসী। সেজো ছেলে আব্দুল খালেদ অনার্সসহ মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে স্টেশন মাস্টার হিসাবে রেলওয়েতে কর্মরত। ৪র্থ সন্তান সার্ফিয়া বেগম বিএ পাসের পর আজিমগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক, ৫ম সন্তান লুৎফা বেগম বিএ পাসের পর রনোচান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসাবে কর্মরত। ৬ষ্ঠ সন্তান অর্থাৎ সর্বকনিষ্ট মেয়ে শারমিন বেগম বিসিএস ৪০তম ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারে যোগদান করেন। বর্তমানে সহকারি কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে দিনাজপুরে কর্মরত। কঠিন পরিস্থিতির মাঝেও আনোয়ারা বেগম তার সন্তানদের মানুষ করতে গিয়ে জীবন যুদ্ধে যে লড়াই চালিয়ে গেছেন এবং সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন তা নারী সমাজের সফলতা অর্জনের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী মালেমহান দেবী : মৌলভীবাজারের প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম মালেমহান দেবীর। পিতা-মাতা ছিলেন শারীরীকভাবে অসুস্থ্য ও দূর্বল। মায়ের পায়ে সমস্যা আর বাবা দূর্বলতা জনিত কারণে ঠিকমত চলাফেরা করতে পারতেন না। তারা ছিলেন দুই ভাইবোন। দারিদ্রতাই যাদের নিত্যসঙ্গী, লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া তাদের জন্য এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। পড়ালেখার ফাঁকে তিনি তার মা-বাবাকে সবধরনের কাজে সাহায্য করতেন। একদম ছোটবেলা থেকেই তার ভেতরে একজন উদ্যোক্তা হওয়ার গুনাবলী প্রকাশ পেতে থাকে। অষ্টম শ্রেনীতে অধ্যয়নকালিন তার বাবা সম্পূর্ণরূপে অকেজো হয়ে পড়লে সংসারের হাল ধরেন মা। তিনি রাত জেগে কাজ করতেন। মায়ের পাশাপাশি ছোট্ট মালেমহান সবধরনের কাজে হাত লাগান। এ সময় তিনি তার মায়ের কাছ থেকে তাঁতের কাজ শিখেন। মহাজনের নিকট থেকে ছোট ছোট কাজের অর্ডার নিতেন। ছোট বলে মহাজন সব সময় কাজ দিতেন না। স্বল্প মুজুরিতে কাজ করে তিনি নিজের ও ছোট ভাইয়ের পড়ালেখার খরচ মেটাতেন। ২০০৮ সালে এসএসসি পরীক্ষার পর মায়ের কানের দুল বিক্রি করে সূতা ও ভালো তাঁত যন্ত্রের ব্যবস্থা করেন। তিনি নতুন ডিজাইনের ট্রেডিশনাল ওড়না বানিয়ে প্রচুর সাড়া পান। সে বছর তিনি একটি এনজিও হতে ঋণ নিয়ে দুটি তাঁত মেশিন সেটআপ করেন। এখান থেকেই তার ঘুরে দাঁড়ানোর যাত্রা শুরু। আশপাশে প্রচুর চাহিদা থাকায় তিনি ওড়না নিয়ে কাজ শুরু করেন, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে থাকেন। কাজের ফাঁকে নিজের পড়াশুনা ও ভাইয়ের পড়াশুনা চালিয়ে নিতে থাকেন। এ সময় তিনি ডিগ্রী পরীক্ষা দেন ও পাশ করেন। তিনি নিজের তৈরী কাপড় ছাড়াও পাশের গ্রাম থেকে কাপড় সংগ্রহ করে সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি শুরু করেন। ব্যবসায় দেখেন লাভের মুখ। তার রোজগারের টাকায় কাঁচা ঘর ভেঙ্গে দালান বাড়ী বানান। বাড়ীতে টিউবওয়েল ব্যবস্থা করেন। মা-বাবার খাবার চালানোর মত আবাদী জমি ক্রয় করেন। ছোট ভাইকে সিলেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে ভর্তি করেন। এসময়ই তিনি বিয়ে করে চলে আসেন বড়লেখায়। করোনাকালীন সময়ে সবকিছু যখন স্থবির, ঠিক তখন তিনি অন-লাইনে ব্যবসার কার্যক্রম চালু রাখেন। অন-লাইন ভিত্তিক ‘উইমেন এন্ড ই-কমার্স ট্রাস্ট’ পেইজের মাধ্যমে তিনি দেশীয় মনিপুরী পণ্যের পরিচিতি তুলে ধরেন। এতে ব্যাপক সাড়া পান। এর মাধ্যমে তিনি ২০ জন তাঁতীকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হন। বড়লেখাতে ‘চিঙলেন’ নামক একটি তাঁতের তৈরী পোষাকের শোরুম চালু করেন। যেখানে তার প্রোডাক্টগুলি বিক্রি করছেন। বেসরকারি টিভি চ্যানেল তাকে ‘কাঞ্চন কন্যা’ এবং মৌলভীবাজার জেলার প্রথম ‘অনন্যা’ হওয়ার সুযোগ করে দেয়। তিনি স্বপ্ন দেখেন একদিন তার ‘চিঙলেন’ ব্র্যান্ডিং হবে এবং সেখান থেকে অসংখ্য নারী উদ্যোক্তার জন্ম হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারী সমাজের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তার পদক্ষেপ প্রশংসাযোগ্য। বড়লেখার এই গৃহবধু এখন অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারীদের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
নতুন উদ্যোমে জীবন শুরু করা সাহসি নারী শিল্পী বেগম : দূরদর্শীতা, আকাঙ্খা বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞা ও সঠিক পরিকল্পনায় এগিয়ে চললে যেকোন বড় বিপর্যয়ও বাধা হতে পারে না এমন ধারনা নিয়ে সামনে এগিয়ে চলা নারীদের প্রতীক শিল্পী বেগম। দারিদ্রতা তার চলার পথকে করে কন্টকময়। শিল্পী বেগমের বয়স যখন তিন মাস তখন তার বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ ঘটে। অন্য একটি মেয়েকে বিবাহ করে বাবা অন্যত্র চলে যান। শিল্পী বেগমের মা তাকে নিয়ে নানার বাড়ী চলে যান। নানার পরিবারেও ছিল না স্বচ্ছলতা। তিনি শিল্পীর মাকে অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দেন। ছোট্ট শিল্পীর জীবন হয়ে উঠে দুর্বিসহ বেদনাময়। নানী তাকে লালন পালন করতে থাকেন। তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। অভাবের কারণে নানা-নানী ছোটবেলাতেই তাকে মানুষের বাসায় কাজে পাঠাতেন। কিন্তু অদম্য শিল্পী বেগম গোপনে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে থাকেন। একটু বড় হলে তার নানা পাশের গ্রামের এক দুশ্চরিত্র ব্যক্তির সাথে শিল্পীর বিয়ে দিয়ে দেন। সে প্রায়ই শিল্পীকে মারধর করত, নির্যাতন করতো। স্বামীর নির্যাতন মুখবুজে সহ্য করতেন। এ সময় তার গর্ভে পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে। একসময় দুষ্ট স্বামী তাকে তালাক দিয়ে অন্য মেয়েকে বিয়ে করে চলে যায়। ছোট্ট একটি সন্তান নিয়ে সে সম্পূর্ণরুপে সহায় সম্বলহীন অসহায় জীবন শুরু করেন। এমন পরিস্থিতিতেও তিনি ভেঙ্গে পরেননি। দৃঢ় মনোবল নিয়ে শক্ত হাতে সবকিছু সামলিয়ে সামনের দিকে এগোনোর প্রচেষ্টা চালান। নেন সেলাই প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে সেলাই কাজ করে কোন রকমে ছেলেকে নিয়ে সংসার চালাতে থাকেন। এ সময় তিনি বিয়ানীবাজার শাহজালাল সঞ্চয় ঋণ সমবায় সমিতি লি. নামক অফিসে মার্কেটিং অফিসার পদে কাজ নেন। এখানে কাজ করে তিনি স্বাবলম্বী হয়ে উঠেন। তার উপার্জিত জমানো টাকায় ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়েছেন। বর্তমানে তিনি একজন সুখি ও স্বাবলম্বী নারী। জীবনের সব গøানী, কালিমা, নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে তিনি স্বমহিমায় সামনে এগিয়ে চলেছেন। কোন বাঁধাই তাকে রুখতে পারেনি। নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যোমে জীবন শুরু করা শিল্পী বেগম এখন অবহেলিত নারী সমাজের প্রতীক।
সমাজ উন্নয়নে প্রিয়া চনুর সাফল্য: জীবন সংগ্রামে লড়াকু নারী প্রিয়া চনু। একজন সমাজ সেবক হিসাবে তিনি এলাকার যেকোন সমস্যা সমাধানে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, যৌতুক বিরোধী আন্দোলন, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সংক্রান্ত বিষয়গুলিতে খুবই সোচ্চার। সমাজের পিছিয়ে পড়া নারী বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মেয়েদের জীবনমান উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করছেন। ব্যক্তি জীবনে এক সন্তানের জননী। সমাজসেবায় তার স্বামী তাকে সার্বিকভাবে সহায়তা করে থাকেন। স্বামীর উৎসাহ প্রেরণায় তিনি হিসাব বিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছেন। ২০২০ সালে বড়লেখার আর.কে লাইসিয়াম স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি সমাজসেবা মূলক কাজও অব্যাহত রেখেছেন। আর্থিক দুরাবস্থার কারণে যে সকল বাচ্চারা ঠিকমত লেখাপড়া করতে পারেনা, তিনি তাদের আর্থিকভাবে সহায়তা করেন, দেন শিক্ষা উপকরণ। তিনি বড়লেখা উপজেলার সমনভাগ গ্রামে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ৬টি সম্প্রদায়ের সমন্বয়ে মহিলাদের জন্য ‘প্রেরণা মহিলা উন্নয়ন সংস্থা’ নামে মহিলা সমিতি করেছেন। এখানে ১০০জন নারীকে সেলাই, বøক-বাটিক, নকশীকাঁথা, হ্যন্ডিক্রাপ্টসসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে সাবলম্বী করে তোলছেন। এসকল মেয়েদের উৎপাদিত পণ্য নিজের দোকানে ও অন্যান্য দোকানে বিক্রির ব্যবস্থা করেন। তিনি তার এই ক্ষুদ্র কুটির শিল্পটিকে আরো বৃহৎ আকারে রূপ দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। স্বপ্ন দেখেন এসকল পিছিয়ে পড়া মেয়েদের সাবলম্বী এবং একটি স্থায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিতে। সমাজসেবায় তার অবদান অবহেলিত ও পিছিয়ে পড়া নারীদের অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে।
caller_get_posts is deprecated. Use ignore_sticky_posts instead. in /home/eibela12/public_html/wp-includes/functions.php on line 6121caller_get_posts is deprecated. Use ignore_sticky_posts instead. in /home/eibela12/public_html/wp-includes/functions.php on line 6121
Leave a Reply