বড়লেখা প্রতিনিধি :
মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির উপদেষ্টা ও কাতার বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শরিফুল হক সাজু বলেছেন, স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ছাত্র আন্দোলনে প্রায় নয়শ’ জনকে হত্যা করেছে। কিন্তু ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি। এক কাপড়ে পালিয়ে যেতে হয়েছে পাশের দেশে। সে দেশে আজকে সে রিফিউজি হিসাবে আছে। কিন্তু আমার নেত্রীকে (বেগম খালেদা জিয়া) যখন ঘর থেকে অন্যায়ভাবে বের করে দিয়েছিল একটি কাপড়ে, তখন আমরা বিদেশে বসে তা টিভিতে দেখে কেঁদেছি। কিন্তু তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাননি। তিনি সেদিন বলেছিলেন, মরতে হলে আমি বাংলাদেশে মরব। এটাই হচ্ছে দেশপ্রেম। দেশের প্রতি ভালোবাসা। দেশ পরিচালনায় তিনি নতুন প্রজন্মকে খালেদা জিয়ার জীবনী পড়ার আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, এখনও ষড়যন্ত্র শেষ হয়নি। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেও তার দোষররা এখনও সক্রিয়। তার একটি প্রমাণ হচ্ছে, দেশের বিভিন্নস্থানে একযোগে বিদ্যুত বন্ধ করে দেওয়া। এই দোসররা রয়ে গেছে, তারা সারা দেশে ক্যু করতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা পারেনি। কারণ দেশপ্রেমিকরা এখনও মরেনি। দেশপ্রেমিকরা এখনও জীবিত আছে। বাংলাদেশে এখন কেউ আর কোনো ষড়যন্ত্র করতে পারবে না।
বিএনপি নেতা শরিফুল হক সাজু শুক্রবার (১৮ অক্টোবর) রাতে বড়লেখা উপজেলার সুজানগর ইউনিয়ন বিএনপি ও সহযোগি সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে ছিদ্দেক আলী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে আয়োজিত দোয়া মাহফিলে সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন। মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির উপদেষ্টা ও কাতার বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শরিফুল হক সাজুর স্বদেশে আগমন এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দেলনে শহীদদের আত্মার মাগফেরাত ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনায় এই দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়। দোয়া পরিচালনা করেন স্থানীয় জামেয়া ইসলামীয়া দারুল উলুম আজিমগঞ্জ মাদ্রাসার উপাধ্যক্ষ মাওলানা আব্দুল কাদির।
রাষ্ট্র সংস্কারে তারেক রহমানের ৩১ দফা রূপরেখা সবার কাছে পৌঁছে দিতে এসেছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমি সবার হাতে ৩১ দফা তুলে দেব। আপনারা এটা পড়লে বুঝতে পারবেন যে দেশনায়ক তারেক রহমান এই দেশকে নিয়ে কতটা চিন্তা করেন। দেশ পরিচালনার জন্য, দেশের পরিবর্তনের জন্য চিন্তা করেন। উনি দলকে প্রায়োরিটি দেন নাই। ৫ আগস্টের পরে উনি দলের বিরুদ্ধে যেভাবে কঠোর হয়েছেন। স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের সময় গোপালগঞ্জের মানুষকে ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী বাহিনীকে বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এটা দেশ পরিচালনা নাকি দল পরিচালনা? আমার নেতা তারেক রহমান বলেছেন, আজকে থেকে যারা বলবে আমি বিএনপি করি, ছাত্রদল করি, আমাকে জব দিতে হবে। তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা বড়লেখা প্রশাসনকে বলেছি, যে বিএনপির পরিচয় দিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করবে তার বিরুদ্ধে আপনারা ব্যবস্থা নেবেন। আমরা চাই না দল নিয়ন্ত্রিত প্রশাসন।
সুজানগর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ফখরুল ইসলাম সুনু মিয়ার সভাপতিত্বে ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নাদের আহমদ এবং উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মকবুল হোসেন সেবুলের যৌথ সঞ্চালনায় দোয়া মাহফিলে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন উপজেলা বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আলাল উদ্দিন, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান সাব্বির আহমদ, উপজেলা বিএনপির সহ-সভাপতি সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান নছিব আলী, সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যাপক আব্দুস শহীদ খান, সহসাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুল ইসলাম খোকন, প্রচার সম্পাদক আব্দুল কুদ্দুস স্বপন, উপজেলা কৃষক দলের সভাপতি মুজিবুর রহমান সেলিম, সুজানগর ইউনিয়ন বিএনপির সহ-সভাপতি আব্দুল বাছিত, সহসভাপতি আব্দুর রাজ্জাক, সহসভাপতি তাজ উদ্দিন শেখ, মনির উদ্দিন, সাংগঠনিক সম্পাদক বদরুল ইসলাম, জেলা যুবদল নেতা আব্দুল কাদির পলাশ, ইকবাল হোসেন, আয়োজক কমিটির সদস্য সচিব বিএনপি নেতা বাবুল আহমেদ, জায়নগর ইউনিয়ন বিএনপির ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক বেলাল আহমদ, ছাত্রদল সভাপতি হাসান আহমেদ, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক সোহান আহমদ প্রমুখ।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নাম শুনলে এখনও বিশ্বের মানুষ সম্মান জানায় উল্লেখ করে বিএনপি নেতা শরীফুল হক সাজু বলেন, আমি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গিয়েছি। সেসব দেশে আমরা যখন বলি, আমাদের দেশে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া আর প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। তখন তারা জিয়ার দেশের মানুষ বলে সম্মান করে। তখন বুকটা গর্বে ভরে যায়। আর যখন বলি, বর্তমানে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তারা তখন বলে তোমরা কী নাস্তিকের দেশে বাস করো!
সরকার পতনের আন্দোলনে প্রবাসীদের অবদানের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রবাসীদের অনেক ভূমিকা রয়েছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে প্রবাসীরা ভূমিকা না রাখত তাহলে সরকার পতন হত না। আমরা এক সপ্তাহ শাটডাউন দিয়েছিলাম, যার কারণে সরকারের পতন হতে বাধ্য হয়েছিল।
সুজানগর ইউনিয়নের মানুষের উদ্দেশ্যে সাজু বলেন, আমি আমার জন্মভূমিতে এক যুগ পর এসেছি। এখানে রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে আসিনি। এই জন্মভূমি থেকে কারা আমাকে বিতাড়িত করেছিল। কারা আসতে দেয়নি তার বিচার আপনাদের দিতে এসেছি।
তিনি সমবসময় উন্নয়নবঞ্চিত সুজানগরকে নিয়ে চিন্তা করেন উল্লেখ করে বলেন, সুজানগর আগর-আতরের রাজধানী। প্রবাসী অধ্যুষিত এলাকা। অথচ বিগত ১৫ বছরের সুজানগর ইউনিয়নকে অবহেলার চোখে দেখা হয়েছে। মানুষকে উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। বিভিন্ন রাস্তাঘাটের চিত্র দেখলে বোঝা যায় তা হাওরের রাস্তার মতো। উন্নয়নের ক্ষেত্রে এখানে কতটা বৈষম্য করা হয়েছে। যখন শুনি ঐহিত্যবাহী ছিদ্দিক আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট অন্য প্রতিষ্ঠানের চেয়ে সর্বনিম্ন। তখন বুকটা ফেটে যায়। কারণ ওই স্কুলের ঐহিত্য ছিল। আজকে সেই ঐতিহ্য চলে গেল। করোনার সময় বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে গালর্স একাডেমি প্রতিষ্ঠিত করেছি। এটা আমাদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্ন আমরা বাস্তবায়ন করেছি। খুব শীঘ্রই এই এলাকায় আমরা মডেল হাইস্কুল করব। আমরা চাই সুজানগরে কলেজ হোক। আগর-আতরের রাজধানী বলা হলেও কেন সেখানে বিদেশী ডেলিগেটরা এসে আগর-আতর কিনতে পারেনা? তিনি বলেন, দেশ নায়ক তারেক রহমান আগামীতে দেশে এলে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। তারেক রহমান দেশের প্রধানমন্ত্রী হলে এই সুজানগরের উন্নয়ন কীভাবে করতে হয়, তা আপনাদের সহযোগিতায় সুজানগরকে একটি আধুনিক ইউনিয়নে রূপান্তর করব।
তিনি বলেন, বিগত ১৭ বছরে বড়লেখাবাসীর ভোট চুরি করে এমপি হোক আর লুকোচুরির মাধ্যমে হোক আমরা এমপি পেয়েছিলাম, মন্ত্রী পেয়েছিলাম। সেই মন্ত্রীর মাধ্যমে আমরা কী পেলাম? আজ আমরা সবার সামনে কথা বলতে হলে লজ্জা হয়। ১৫’শ কোটি টাকা যদি এক টেহুার থেকে দুর্নীতি হয়, তাহলে ৫ বছরে কত কোটি টাকা দুর্নীতি হয়েছে? আমরা সবাইকে বলি ফেরেশ্তা। আমরা রাজনীতি করতে এসেছি। ব্যবসা করতে আসিনি। এই দুর্নীতিগ্রস্থদের আবার সুযোগ দিলে দেশ কখনও এগিয়ে যাবে না। উন্নতি লাভ করবে না। এই দেশ, সমাজ ও এলাকাকে এগিয়ে নিতে হলে আপনারা সঠিক মানুষকে মূল্যায়ন করতে হবে। এতে আগামীতে বড়লেখা-জুড়ীতে উন্নয়নের জোয়ার সৃষ্টি হবে। সেই জোয়ার হবে দেশ নায়ক তারেক রহমানের জোয়ার।
সীমান্তে স্বর্ণা দাস হত্যার প্রতিবাদ করায় তাকে নানা ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে উল্লেখ করে শরীফুল হক সাজু বলেন, স্বর্ণা হতে পারে সনাতন ধর্মাবলম্বী। সে আমার বোন। আমার বোনকে বিএসএফ গুলি করল। সে হয়ত অবৈধভাবে ভারতে যেতে চেয়েছিল কিংবা তার আত্মীয়ের সাথে দেখা করতে চেয়েছিল। তাকে ধরে পুলিশে দেওয়া যেত পারত। কিন্তু তাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হল। অথচ কেউ এই ঘটনায় প্রতিবাদ করল না। আমি একাই প্রতিবাদ শুরু করলাম। আমাকে বিভিন্নভাবে হুমকি-ধমকি দেওয়া হল। কিন্তু আমি থেমে থাকিনি। বিষয়টি যখন আমি আমার নেতাকে ফোন করে বলি। উনি জানার পরে সর্বোচ্চ নীতি র্নিধারক টিম এক সপ্তাহের মধ্যে স্বর্ণার বাড়িতে পাঠানো হলো। আগামিতে তারেক রহমানের নেতৃত্বে দেশ পরিচালতি হলে স্বর্ণার নামে একটি প্রতিষ্ঠান করব। সেটা কী ধরনের প্রতিষ্ঠান হবে, তা জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে। আমরা কথা এবং কাজে বিশ্বাসী। যা বলব তাই করব।
তিনি বিএনপির রাজনীতি করায় তাকে এবং তার পরিবারকে বিভিন্ন ধরনের হয়রানি করা হয়েছে উল্লেখ করে বলেন, আমার পরিবারের অবস্থা নিশ্চয়ই আপনারা জানেন। দলের জন্য, নেতাকর্মীদের জন্য রাজনীতি করতে কী করেছি। কাতারে থাকাঅবস্থায় দূতাবাসের মাধ্যমে বিভিন্ন হয়রানি করা হয়েছিল। শেষপর্যন্ত কাতার থাকার জন্য আমার পাসপোর্ট রিনিউ করতে পারিনি। পাসপোর্ট রিনিউ করতে আমাকে অন্য দেশের ভিসা লাগাতে হয়েছে। কারও সাথে কোনোদিন অন্যায় করিনি। আমার একটাই অপরাধ ছিল, আমি নিয়ে কথা বলতাম। দেশের জনগণকে নিয়ে কথা বলতাম। জনগণের পক্ষে কথা বলতাম। সেটাই ছিল আমার অপরাধ। দলের পদ পেয়ে দায়িত্ব পালনে বিভিন্ন দেশে গিয়েছি। কারও কাছ থেকে এক কাপ চাও খাইনি। নিজের বাবার টাকা, পরিশ্রম আর ঘাম দলের পেছনে ব্যয় করে দলকে সুসংগঠিত করেছি। রাজনীতি করার কারণে আমার পরিবারকে নানাভাবে হয়ারানি করা হয়েছে। আমার বাড়িতে পুলিশ কয়েকবার গিয়েছে। আমার সম্পর্কে তথ্য নিয়েছে। শেষপর্যন্ত যখন তারা দেখেছে আমাকে থামাতে পারছে না। আমার লেখা বন্ধ করতে পারছে না। দেশের পক্ষে, দেশ নেত্রী খালেদা জিয়ার পক্ষে কথা বলা বন্ধ করতে পারেনি। তখন তারা কী করল। আমার ছোট ভাই মালেশিয়ায় লেখাপড়া করত। মা-বাবার সাথে দেখা করতে দেশে আসছে। ঢাকা এয়ারপোর্টে নামার পরে আমার ভাইকে তুলে তারা নিয়ে গেল। এক সপ্তাহ আমার ভাইয়ের কোনো সন্ধান পাইনি। এই সাতদিন আমাদের জীবনে সাতটা বছরের সমান ছিল। আমরা এক সেকেন্ড ঘুমাইনি। সেদিন আমার বাবা-মায়ের চোখের পানি দেখেছিলাম, আমার ভাইদের চোখে পানি দেখেছিলাম। আমার ভাইকে আয়না ঘরে নিয়ে রাখা হয়েছিল। সাতদিন পরে অর্থের বিনিময়ে আমার ভাইকে ফিরত পেয়েছি। সাথে সাথে আমার ভাইকে আমরা চায়না পাঠিয়ে দিই। এই দেশটা ছিল প্রতিহিংসামূলক। যখন আপনাকে পায়নি আপনার ভাইকে ধরবে। আপনাকে যখন পাবে না আপনার স্ত্রীকে ধরবে, অথবা সন্তানকে ধরবে। এটাই হচ্ছে ফ্যাসিবাদের রাজত্ব। যখন সরকারের বিরুদ্ধে মানুষ চলে যায়, জনগন চলে যাবে, তখন তার মুখ বন্ধ করতে তারা নানা ষড়যন্ত্র করবে। তিনি বলেন, বিগত দিনে যখন কেউ আমাকে ফোন করেছে। আমি কল ধরেছি। কথা বলেছি। পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। আমি আমার পরিবারকে এতটা সময় দেইনি। এক মাসের জন্য পরিবারের কাছে আমেরিকায় গিয়েছিলাম। যখন দেখলাম ছাত্র আন্দোলন চলছে, তখন পরিবারকে সময় দিইনি। সেখানেও দলের জন্য কাজ করেছি।
Leave a Reply