ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ ::
আগস্টের শেষ দিনে সর্বাধিক পৌঁছেছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। শনিবার সকাল ৮টা থেকে রবিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ৫৬৮ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এর আগে সর্বোচ্চ ভর্তি রেকর্ড ছিল ৭ জুলাই, যখন ৪৯২ জন রোগী ভর্তি হয়েছিলেন।সরকারি হিসাব অনুযায়ী, চলতি মাসে হাসপাতাল ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১০,৪৯৬ জন, আর চলতি বছরে মোট ভর্তি হয়েছে ৩১,৪৭৬ জন।গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। সকলেই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের হাসপাতালের রোগী ছিলেন। মারা যাওয়াদের মধ্যে দুইজন নারী (১৬–২০ বছর) এবং দুইজন পুরুষ (৪১–৬০ বছর)। চলতি বছরে ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যু হয়েছে ১২২ জন, এর মধ্যে পুরুষ ৬৭ জন, নারী ৫৫ জন। জুলাই মাসে সর্বাধিক মৃত্যু হয়েছে ৪১ জনের।সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সালে ৫,৫৫১ রোগী।২০২৩ সালে ৩,২১,১৭৯ রোগী, মৃত্যু ১,৭০৫ জন।২০২৪ সালে ১,০১,২১৪ রোগী, মৃত্যু ৫৭৫ জন।সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের ডেঙ্গু পরিস্থিতি বিশেষ সতর্কতার দাবি করছে।ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যা মূলত এডিস মশা (এডিস এগিপ্টি ও এডিস আলবোপিক্টাস) দ্বারা সংক্রমিত হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। বিশেষ করে বর্ষাকাল ও বর্ষার পরবর্তী সময়ে জলাবদ্ধতার কারণে মশার বৃদ্ধি ডেঙ্গুর প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত। ২০২৫ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং কিছু ক্ষেত্রে দৈনিক নতুন আক্রান্তের সংখ্যা হাজারের ঘরে পৌঁছাচ্ছে।
> ডেঙ্গুর বৃদ্ধি বৃদ্ধির কারণ
বর্তমান সময়ে ডেঙ্গু বৃদ্ধির মূল কারণগুলো হলো:
১. পরিবেশগত কারণে মশার প্রজনন: – শহরাঞ্চলে আবর্জনা এবং জমে থাকা পানি মশার প্রজননের জন্য সহায়ক। বিশেষ করে প্লাস্টিকের বোতল, টায়ারের মধ্যে জমে থাকা পানি ডেঙ্গু বাহক মশার লার্ভা জন্১
২. নগরায়ন ও জনসংখ্যার ঘনত্ব বৃদ্ধি:- ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোতে মশা দ্রুত বিস্তার লাভ করে।
৩. পরিবেশ দূষণ ও জলাবদ্ধতা:- নর্দমা ও খাল, নদীর ধারের অব্যবস্থাপনা মশার আবাসস্থল বৃদ্ধি করে।
৪. প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে অবহেলা:- ঘর ও আশেপাশের পরিবেশে নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা না রাখার ফলে সংক্রমণ সহজ হয়।
৫. আন্তঃদেশীয় যাতায়াত:- দেশি-বিদেশি যাত্রীর মাধ্যমে ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
> ডেঙ্গুর লক্ষণ
ডেঙ্গু সাধারণত সংক্রমণের ৪–১০ দিনের মধ্যে লক্ষণ প্রকাশ করে।
* হঠাৎ জ্বর, যা ১০২–১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৩৮–৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) পর্যন্ত বৃদ্ধি পায় * তীব্র মাথা ব্যথা এবং চোখের পেছনের ব্যথা * ত্বকে লাল দাগ বা দানা * অস্থিরতা, ক্লান্তি, শারীরিক দুর্বলতা * পেশী ও জয়েন্টের ব্যথা (এটি ‘হাড় ভাঙার জ্বর’ নামেও পরিচিত)
* কিছু ক্ষেত্রে বমি ভাব ও বমি * শিশুর মধ্যে কখনও কখনও হঠাৎ রক্তপাত (নাক বা মাড়ি)
> ডেঙ্গুর প্রকারভেদ
* ডেঙ্গু ভাইরাস মূলত চারটি ধরনের বিভক্ত: ডিইএন-১, ডিইএন-২, ডিইএন-৩, ডিইএন-৪।
* সাধারণ ডেঙ্গু: জ্বর, মাথাব্যথা, পেশী ব্যথা, দানা; সাধারণত মৃত্যু হয় না।
* ডেঙ্গু রক্তপাত জ্বর: রক্তপাত, প্লাটিলেটের হ্রাস, শ্বাসকষ্ট, মাথা ঘোরা; গুরুতর হলে মৃত্যু হতে পারে।
* ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোম: রক্তচাপ হ্রাস, শক, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কার্যকারিতা হ্রাস; অবিলম্বে চিকিৎসা প্রয়োজন।
> রোগ নির্ণয়
ডেঙ্গুর সঠিক নির্ণয়ের জন্য ল্যাবরেটরির পরীক্ষার প্রয়োজন হয়। সাধারণ পদ্ধতিগুলো হলো:
* এনএস১ অ্যান্টিজেন পরীক্ষা: সংক্রমণের প্রথম ৫–৭ দিনে ভাইরাস সনাক্ত করতে সাহায্য করে।
* আইজিএম/আইজিজি অ্যান্টিবডি পরীক্ষা: রোগের প্রাথমিক বা দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণ নির্ণয় করে।
* রক্তের পূর্ণ পরীক্ষা: হিমোগ্লোবিন, শ্বেত রক্তকণিকা ও প্লাটিলেটের পরিমাণ পরীক্ষা করে রোগের জটিলতা নির্ণয় করা হয়।
> জটিলতা
ডেঙ্গুর জটিলতা সাধারণত ডেঙ্গু রক্তপাত জ্বর বা ডেঙ্গু শকে দেখা দেয়। গুরুত্বপূর্ণ জটিলতার লক্ষণগুলো হলো:- * ক্রমাগত জ্বর এবং তীব্র বমি * রক্তপাত (নাক, মাড়ি, মল, প্রস্রাব)
* প্লাটিলেটের মাত্রা খুব কমে যাওয়া * রক্তচাপ কমে যাওয়া, শক * অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতি বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যকারিতা হ্রাস।এই অবস্থায় অবিলম্বে হাসপাতালে ভর্তি ও চিকিৎসা প্রয়োজন। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করলে মৃত্যুর ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
> ঘরোয়া পরামর্শ ও প্রতিরোধ
ডেঙ্গু থেকে সুরক্ষা এবং প্রাথমিক ব্যবস্থাপনার জন্য কিছু ঘরোয়া পরামর্শ হলো:
১. পরিবেশ পরিচ্ছন্নতা: বাড়ির চারপাশে পানি জমতে না দেওয়া, টায়ার, খোলা পাত্র, ফুলের পানি নিয়মিত খালি করা।
২. মশার প্রতিরোধ: রাতের বেলা মশারি ব্যবহার, শরীর ঢেকে রাখার কাপড় পরা, কীটনাশক স্প্রে।
৩. পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও পানি সেবন: পর্যাপ্ত পানি খাওয়া রোগীর জন্য খুব জরুরি।
৪. জ্বর নিয়ন্ত্রণ: প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ প্রয়োগ করা যায়; অ্যাসপিরিন বা আইবুপ্রোফেন ব্যবহার না করা ভালো, কারণ এগুলো রক্তপাত বাড়াতে পারে।
৫. ডাক্তারের পরামর্শ: হালকা ডেঙ্গু হলেও ল্যাব পরীক্ষা ও ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
৬ . নির্দিষ্ট লক্ষণ পর্যবেক্ষণ: প্লাটিলেট সংখ্যা কমে গেলে অবিলম্বে হাসপাতালে যাওয়া।
> হোমিও প্রতিকার :- ডেঙ্গু বর্তমানে বাংলাদেশে একটি গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি। এটি মূলত এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায় এবং ভাইরাসজনিত হওয়ায় এর কোনো নির্দিষ্ট এলোপ্যাথিক প্রতিষেধক নেই। এ অবস্থায় হোমিওপ্যাথি অনেক ক্ষেত্রেই সহায়ক চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে কার্যকর হতে পারে। যদিও একে একমাত্র সমাধান মনে করা উচিত নয়, তবুও রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে এবং প্রতিরোধে এটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। ডেঙ্গুর সাধারণ লক্ষণ হলো উচ্চ জ্বর, মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা, শরীর ও হাড়ে ব্যথা, অতিরিক্ত দুর্বলতা, বমি কিংবা চর্মে ফুসকুড়ি। এসব ক্ষেত্রে রোগীর লক্ষণ অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন হোমিও ঔষধ প্রয়োগ করা হয়। যেমন—ব্রায়োনিয়া এল্ব, জেলসিয়াম, রাস টক্স, আর্সেনিকাম এল্ব, বেলাডোনাসহ আরো অনেক ঔষধ লক্ষণের উপর আসতে পারে।হোমিওপ্যাথি রোগীর দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, জ্বর নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং সুস্থ হতে সহায়তা করে। তবে চিকিৎসার পাশাপাশি পর্যাপ্ত বিশ্রাম, তরল খাবার, প্রচুর পানি ও ওরস্যালাইন খাওয়া এবং মশা এড়ানো অত্যন্ত জরুরি।সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—যদি রোগীর রক্তপাত শুরু হয়, প্লাটিলেট দ্রুত কমে যায় অথবা অবস্থা জটিল হয়, তখন আর দেরি না করে অবিলম্বে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া আবশ্যক। হোমিওপ্যাথি কেবল সহায়ক চিকিৎসা, তাই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে ব্যবহার করাই শ্রেয়।
পরিশেষে বলতে চাই,বর্তমান সময়ে ডেঙ্গু একটি গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে, যা দ্রুত শনাক্ত ও সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ না করলে প্রাণহানি পর্যন্ত ঘটাতে পারে। ডেঙ্গুর মূল কারণ হলো আক্রান্ত মশার মাধ্যমে ভাইরাসের সংক্রমণ। তাই মশা নিয়ন্ত্রণ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ বজায় রাখা, এবং নিজস্ব পরিচ্ছন্নতার প্রতি খেয়াল রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে রোগের প্রাথমিক লক্ষণ যেমন জ্বর, মাথা ব্যথা, শরীরের ব্যথা এবং র্যাশ লক্ষ করলেই দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া উচিত। পরিবার ও সমাজের সচেতনতা, স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং নিয়মিত পর্যবেক্ষণ রোগ প্রতিরোধে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে সরকার, স্বাস্থ্যকর্মী এবং স্থানীয় জনগণকে একসাথে কাজ করতে হবে। ঘরে ও আশেপাশের এলাকায় জল জমতে না দেওয়া, আবর্জনা সঠিকভাবে ফেলা এবং মশার দমন কার্যক্রমে সক্রিয় থাকা ডেঙ্গু সংক্রমণ কমাতে সহায়ক। সতর্কতা, সচেতনতা এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা মিলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।#
লেখক- চিকিৎসক, কলাম লেখক ও গবেষক
প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
Leave a Reply