আনোয়ার হোসেন রনি, ছাতক (সুনামগঞ্জ) প্রতিনিধিঃ
তাঁর জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে রয়েছে,মারিয়া ভূজজ্ঞ তীর কলিজা করিলো চৌচির, “নামাজ আমার হইল না আদায়” “আমি জন্মে জন্মে অপরাধী তোমারই চরণে রে” “সুখের নিশি প্রভাত হলো” “ছাড়িয়া যাইও না বন্ধু রে” “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি,—এসব গানগুলো শুধু সুরের আবেদনেই নয়, বরং দার্শনিক ও মানবিক বার্তার কারণেও কালজয়ী হয়ে উঠেছে গ্রাম গঞ্জে। মুক্তিযুদ্ধ ও সমাজচেতনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দুর্ব্বিন শাহ অসংখ্য জাগরণী গান রচনা ও পরিবেশন করেছিলেন। চল রে ভাটি দেশে, যাইয়া হাওরে,সহ তাঁর কালজয়ী গান “ফকির দুর্ব্বিন শাহ।
বাংলার লোকসংগীত ঐতিহ্যে অসংখ্য সাধক, বাউল, সুফি ও মরমি কবি তাঁদের সৃষ্টিকর্ম দিয়ে মানবতাবোধ ও আধ্যাত্মিক চেতনা জাগ্রত করেছেন। লালন ফকির, হাসন রাজা, রাধারমণ দত্তের মতোই ভাটি বাংলার মানুষের প্রাণের অন্তরঙ্গ শিল্পী ছিলেন ফকির দুর্ব্বিন শাহ। তিনি ছিলেন একাধারে সুফি সাধক, গীতিকার, সংগীত রচয়িতা, দার্শনিক ও জীবন দর্শনের শিক্ষক। তাঁর গানে একদিকে যেমন ভাটি অঞ্চলের জনজীবন ও প্রেম–বিরহ ফুটে উঠেছে, অন্যদিকে রয়েছে মানবতাবাদ, অসাম্প্রদায়িকতা ও ভক্তিমূলক দর্শনের স্পর্শ। দুর্ব্বিন শাহ তাঁর গানকে কেবল বিনোদন হিসেবে ব্যবহার করেননি; বরং তা মানুষের নৈতিক জাগরণ, আল্লাহ প্রেম ও সত্য অনুসন্ধানের মাধ্যম করে তুলেছিলেন। এদের মধ্যে অন্যতম এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ফকির দুর্ব্বিন শাহ। ভাটি বাংলার আকাশে তিনি ছিলেন আলোকবর্তিকা, যিনি গান ও দর্শনের মিশেলে সাধারণ মানুষের হৃদয় জয় করেছিলেন। ভক্তরা তাঁকে শ্রদ্ধাভরে ডাকেন “জ্ঞানের সাগর”। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য—এই মরমি সাধক আজও কোনো বড় রাষ্ট্রীয় কোনো স্বীকৃতি পাননি।
১৯২১ সালের ২ নভেম্বর সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার নোয়ারাই গ্রামের তারামনি টিলায় জন্মগ্রহণ করেন দুর্ব্বিন শাহ। তাঁর পিতা সুফি সাধক সফাত আলী শাহ ও মাতা হাসিনা বানুর ধর্মীয়-আধ্যাত্মিক পরিবেশ তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। খুব বেশি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও—শুধু পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন—তবুও জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন অসাধারণ। সঙ্গীত ও দর্শনে তাঁর জ্ঞান ছিল অকল্পনীয় সমৃদ্ধ। কৈশোরেই গ্রামের আখড়ায় গান গেয়ে জনমনে পরিচিতি পান তিনি।
মালজুড়া গানের জনক দুর্ব্বিন শাহ্ । যিনি শুধুই বাউল ছিলেন না; তিনি ছিলেন “মালজুড়া গানের জনক”। তাঁর গান ছিল প্রেম, দেহতত্ত্ব, সুফি দর্শন, সমাজচেতনা ও মানবতাবাদের এক অনন্য মিশ্রণ। তিনি বিশ্বাস করতেন—মানুষের অন্তরেই সত্য ও স্রষ্টার দ্বার লুকিয়ে আছে। তাই তাঁর গান সহজবোধ্য ও হৃদয়গ্রাহী ছিল। সাধারণ মানুষ সহজেই তা বুঝতে পারত এবং তাই দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তাঁর কালজয়ী গান মানুষের হৃদয়ের আর্তি ও জীবনের বেদনা ফুটিয়ে তোলে। আবার “আমার অন্তরায়, আমার কলিজা” গানটি দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এই গানগুলো আজও বাউলপ্রেমীদের কণ্ঠে ভেসে বেড়ায়। রচনা ও সংগ্রামী চেতনা প্রায় এক হাজার গান রচনা করেছিলেন দুর্ব্বিন শাহ, যার মধ্যে চার শতাধিক গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর গান শুধু বিনোদন নয়, ছিল সমাজ চেতনা ও মানবিক বার্তার বাহক। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাঁর গান মুক্তিকামী মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছিল। অস্ত্র হাতে না নিলেও তাঁর সুর হয়ে উঠেছিল সংগ্রামী জনতার মানসিক শক্তি।
সাহিত্যকীর্তি
ফকির দুর্ব্বিন শাহ প্রায় এক হাজারেরও বেশি গান রচনা করেছিলেন, যার মধ্যে প্রায় চার শতাধিক গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা হলো—
• প্রেমসাগর পল্লীগীতি (প্রথম থেকে পঞ্চম খণ্ড)
• পাক বঙ্গ ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ গীতি
• দুর্ব্বিন শাহ সমগ্র
, ফকিক দুব্বিন শাহ
,আল্লামা দুব্বিন শাহ
,ফকির দুর্ব্বিন শাহ
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
লোকসঙ্গীতকে আন্তর্জাতিক পরিসরে তুলে ধরতেও তিনি ছিলেন অগ্রণী। ১৯৬৭ সালে কিংবদন্তি শিল্পী শাহ আবদুল করিমের সঙ্গে তিনি লন্ডনে গান পরিবেশন করেন। সেখানেই তিনি “জ্ঞানের সাগর” উপাধি পান। শুধু তাই নয়, ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্র “যুক্তি তক্কো আর গপ্পো”-তে তাঁর গান ব্যবহার করা হয়। এর ফলে তাঁর গান আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও অমরত্ব পায়।
মৃত্যুর পরও অম্লান স্মৃতি
১৯৭৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর প্রায় পাঁচ দশক পরও তিনি ভক্তদের হৃদয়ে সমানভাবে বেঁচে আছেন। ছাতকের “দুর্ব্বিন টিলা”-য় প্রতিবছর অসংখ্য ভক্ত ও সাধক তাঁর স্মরণে সমবেত হন। গান গেয়ে তাঁকে স্মরণ করেন, যেন তিনি আজও জীবন্ত হয়ে তাঁদের মাঝে ফিরে আসেন।
রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি থেকে আজও বঞ্চিত
লোকসঙ্গীতের ইতিহাসে লালন, হাসন রাজা কিংবা শাহ আবদুল করিম যথাযোগ্য রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছেন। কিন্তু দুর্ব্বিন শাহ এখনো সেই মর্যাদা থেকে বঞ্চিত কেন ? বাংলা লোকসঙ্গীতকে তিনি যে সমৃদ্ধ করেছেন, তাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। তাঁর গান শুধু শিল্প নয়, দর্শন ও মানবতাবাদের দৃষ্টান্ত। ভাটি বাংলার মানুষের সংস্কৃতিতে তিনি অমূল্য সম্পদ। আজকের দিনে প্রশ্ন জাগে—বাংলা লোকসঙ্গীতে দুর্ব্বিন শাহের অবদান কি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবিদার নয়? তিনি কি কেবল ভক্ত-শিষ্যদের সীমিত পরিসরে থেকে যাবেন? নাকি রাষ্ট্র একদিন তাঁকে প্রাপ্য সম্মান দেবে? ফকির দুর্ব্বিন শাহ কেবল একজন লোকশিল্পী ছিলেন না; তিনি ছিলেন বাংলার আত্মার প্রতিচ্ছবি। তাঁর গান ছিল মানুষের ভেতরের সত্য, ভালোবাসা ও মুক্তির অমলিন উচ্চারণ। আজ, যখন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নিয়ে বিতর্ক ওঠে, তখন মানুষ মনে করে—বাংলার লোকসঙ্গীতের এই মরমি সাধকও প্রাপ্য মর্যাদার অপেক্ষায় আছে। ভাটি বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে হলে দুর্ব্বিন শাহের গান অনন্য সম্পদ হতে পারত।
ফকির দুর্ব্বিন শাহ কেবল একজন লোকশিল্পী বা গীতিকার নন, তিনি ছিলেন ভাটি বাংলার আত্মা। তাঁর গান আমাদের শোনায় মানুষের দুঃখ-কষ্ট, প্রেম-বিরহ, আধ্যাত্মিক সাধনা ও মানবতার জয়গান। তাই তাঁর গানকে নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া এবং রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির আওতায় আনা আজ সময়ের দাবি।###
caller_get_posts is deprecated. Use ignore_sticky_posts instead. in /home/eibela12/public_html/wp-includes/functions.php on line 6121caller_get_posts is deprecated. Use ignore_sticky_posts instead. in /home/eibela12/public_html/wp-includes/functions.php on line 6121
Leave a Reply