ছাতক (সুনামগঞ্জ) প্রতিনিধি::
সুনামগঞ্জ–৫ (ছাতক–দোয়ারাবাজার) আসনে বিএনপির মনোনয়নকে ঘিরে শুরু হয়েছে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা। দলের এই গুরুত্বপূর্ণ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী হয়েছেন দুই প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় নেতা—সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও জেলা বিএনপির আহবায়ক কলিম উদ্দিন আহমেদ মিলন এবং কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান চৌধুরী মিজান। দুজনেই দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে সক্রিয় এবং মাঠপর্যায়ে তাদের অনুসারীরাও সমানতালে কাজ করে যাচ্ছেন। ফলে বিএনপির মনোনয়ন যুদ্ধে এখন ছাতক–দোয়ারাবাজারের রাজনীতি উত্তপ্ত।
দলের হাইকমান্ড একজনকেই শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত মনোনয়ন দেবে, কিন্তু মাঠে দুই প্রার্থীর তৎপরতায় সমর্থক ও সাধারণ ভোটারদের মধ্যেও তৈরি হয়েছে উৎসাহ ও কৌতূহল। দীর্ঘ ১৭ বছরের দমন–নিপীড়ন, মামলা–হামলা ও দলীয় দুর্দিনে কে কতটা নিবেদিত থেকেছেন—এই মূল্যায়নই হতে পারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের মাপকাঠি। দলীয় নীতিনির্ধারকরা ইঙ্গিত দিয়েছেন—ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাকেই এবার অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
কলিম উদ্দিন আহমেদ মিলন : ত্যাগ, অভিজ্ঞতা ও ধারাবাহিক নেতৃত্বের প্রতীক দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী কলিম উদ্দিন আহমেদ মিলন বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক এবং সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির আহবায়ক।
তিনি তিনবারের সাবেক সংসদ সদস্য। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) থেকে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন পেয়ে দ্বিতীয়বার এমপি হন।
দলীয় দায়িত্বের ক্ষেত্রে মিলন ছিলেন সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক, পরবর্তীতে সাধারণ সম্পাদক এবং বর্তমানে আহবায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবেও কাজ করছেন। তার রাজনৈতিক জীবনে রাজপথে নেতৃত্বের ইতিহাস দীর্ঘ—দলের প্রতিটি আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন তিনি।
দলীয় সূত্র জানায়, মিলনের বিরুদ্ধে ছাতক, দোয়ারাবাজার ও সুনামগঞ্জ থানায় প্রায় ৯টি রাজনৈতিক মামলা রয়েছে। আন্দোলন–সংগ্রামের সময় রাজপথে থাকার কারণেই এসব মামলা হয়েছে বলে দাবি তার অনুসারীদের।
২০০১–২০০৬ মেয়াদে সংসদ সদস্য থাকার সময় তিনি শিক্ষা, যোগাযোগ ও অবকাঠামো উন্নয়নে একাধিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন। স্থানীয়রা জানান, তার সময়কালে কোনো বড় দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। ২০০৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে তিনি ধানের শীষ প্রতীকে প্রায় এক লাখ ভোট পান, যা তখনকার সময়ের রাজনৈতিক বাস্তবতায় একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন হিসেবে বিবেচিত।
সংগ্রামী নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা ২০১৩ সালের ৮ ডিসেম্বর ছাতকের সংঘর্ষ, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন বিরোধী আন্দোলন এবং ২০২৩ সালের নভেম্বরের অবরোধ–অভিযানসহ নানা ঘটনায় তিনি রাজপথে নেতৃত্ব দেন। এসব ঘটনায় তার বিরুদ্ধে নতুন করে একাধিক মামলা হয়। বিশেষ করে মদনপুর গাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগে বিশেষ ক্ষমতা আইনে দায়েরকৃত মামলায় তিনি জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদকসহ ৫৯ জনের অন্যতম আসামি। তবুও তিনি থেমে থাকেননি—বিএনপির দুর্দিনে মাঠে থেকে দলের নেতৃত্ব ধরে রেখেছেন।
জনভিত্তি ও জনপ্রিয়তা ছাতক–দোয়ারাবাজারের তৃণমূল নেতাকর্মীরা মিলনকে দলের “ত্যাগী সৈনিক” হিসেবে বিবেচনা করেন। বিএনপির প্রতিটি দুর্যোগে তার উপস্থিতি ও নেতৃত্ব কর্মীদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে বলে জানান পৌর বিএনপির আহবায়ক শামছুল ইসলাম সামছু ও সামছুর রহমান বাবুল বলেন, “ধানের শীষের কান্ডারি হবেন জেলা বিএনপির জননন্দিত আহবায়ক কলিম উদ্দিন আহমেদ মিলন। তার বিকল্প জেলায় আর কেউ নেই।”
মিজানুর রহমান চৌধুরী মিজান : তরুণ, সংগঠিত ও প্রভাবশালী নেতৃত্বের প্রতিনিধি অন্যদিকে, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মিজানুর রহমান চৌধুরী মিজান তুলনামূলকভাবে তরুণ ও সংগঠিত নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
ছাত্রজীবনে তিনি সিলেটের ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন এবং সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে পরিচিতি পান।
ছাতকের ভাতগাঁও ইউনিয়নের হায়দরপুর গ্রামের কৃতি সন্তান মিজান ২০০৯ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে জনসম্পৃক্ত নেতৃত্বের স্বাক্ষর রাখেন।
২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি তাকে মনোনয়ন দেয়। তখন তিনি কলিম উদ্দিন মিলনের স্থলাভিষিক্ত হয়ে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করেন এবং আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিপরীতে প্রায় ৯৪ হাজার ভোট পান।
প্রশাসনিক বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও মিজান চৌধুরীর মাঠে লড়াই ছিল চোখে পড়ার মতো। এ সময় তিনি তরুণ প্রজন্মের মধ্যে আলোচিত ও গ্রহণযোগ্য মুখে পরিণত হন।
সংগঠন ও আইনি চ্যালেঞ্জ রাজনৈতিক জীবনে তার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা রয়েছে—২০১৫ সালের অবরোধ-হরতাল চলাকালে যাত্রীবাহী বাসে বোমা হামলা মামলা, ২০২৩ সালের নভেম্বরের সড়ক অবরোধ মামলা, এবং একই বছরের ডিসেম্বর মাসে জয়কলস হাইওয়ে থানায় দায়ের করা গাড়ি পোড়ানোর মামলা। তবুও সংগঠনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত থেকে তিনি তরুণদের দলে সম্পৃক্ত করছেন। তার অনুসারীদের মতে, “মিজান চৌধুরীই হচ্ছেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নেতৃত্বের প্রতীক।”
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ছাতক–দোয়ারাবাজার এলাকায় মিজান নিজস্ব ভোট ব্যাংক তৈরি করেছেন। মাঠপর্যায়ে নিয়মিত গণসংযোগ, উঠান বৈঠক ও ডিজিটাল প্রচারণার মাধ্যমে তরুণ ভোটারদের কাছে পৌঁছেছেন তিনি। দলের একাধিক নেতা বলছেন, সংগঠনের আধুনিক ব্যবস্থাপনা ও যোগাযোগ দক্ষতায় মিজান চৌধুরী নতুন ধারার নেতৃত্ব উপস্থাপন করছেন।
দুই প্রজন্ম, এক মনোনয়ন যুদ্ধ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সুনামগঞ্জ–৫ আসনে বিএনপির এই মনোনয়ন লড়াই মূলত অভিজ্ঞতা বনাম তরুণ নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা। অভিজ্ঞতা, নেটওয়ার্ক ও জেলা-স্তরের প্রভাবের দিক থেকে কলিম উদ্দিন মিলন কিছুটা এগিয়ে থাকলেও, মাঠপর্যায়ে জনপ্রিয়তা ও সংগঠনের গতিশীলতায় মিজান চৌধুরীও শক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছেন। এক স্থানীয় বিশ্লেষক বলেন,“কলিম উদ্দিন আহমেদ মিলন জেলা রাজনীতির মূলধারার সঙ্গে যুক্ত, তিনি সিনিয়র নেতাদের আস্থাভাজন।
অন্যদিকে মিজান চৌধুরী তরুণ নেতৃত্বের প্রতীক হিসেবে মাঠে দারুণ সক্রিয়। ফলে মনোনয়ন প্রশ্নে বিএনপি এবার ভারসাম্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবে বলেই ধারণা।”মাঠপর্যায়ের তৎপরতা ও ঐক্যের বার্তা দু’জনই বর্তমানে পৃথকভাবে সভা-সমাবেশ, উঠান বৈঠক ও গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন।
তবে জেলা বিএনপির কমিটি পরিচালনায় দুজনকে একসঙ্গে কাজ করতে দেখা যায়, যা দলীয় ঐক্যের দিক থেকেও ইতিবাচক বার্তা দেয়। দলীয় নেতারা বলছেন, মিলন–মিজান উভয়েই বিএনপির রাজনীতিতে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও দলের বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্য রক্ষা করছেন।
দলীয় হাইকমান্ডের ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি এমন প্রার্থীকেই অগ্রাধিকার দেবে, যিনি ত্যাগী, যোগ্য ও জনগণের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। দলীয় এক শীর্ষ নেতা বলেন—“যারা দমন–নিপীড়ন, মামলা–হামলা সত্ত্বেও দলের পতাকা উঁচিয়ে রেখেছেন,যারা রাজপথে থেকেছেন এবং জনগণের পাশে ছিলেন—
তাদেরই এবার মূল্যায়ন করা হবে।”এমন পরিস্থিতিতে ছাতক–দোয়ারাবাজারের মানুষ এখন তাকিয়ে আছেন বিএনপির চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিকে। রাজনৈতিক ভবিষ্যতের নির্ধারক আসন সুনামগঞ্জ–৫ আসন দীর্ঘদিন ধরেই বিএনপির অন্যতম ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত।
২০০১ সালের নির্বাচনে এ আসনে বিএনপি জয় পেয়েছিল, কিন্তু পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক বাস্তবতায় ক্ষমতা হারায়। বর্তমানে স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপির পুনর্গঠন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হচ্ছে—যেখানে মিলন ও মিজান দুই প্রজন্মের নেতৃত্বের প্রতীক হয়ে উঠেছেন। রাজনীতিবিদরা বলছেন, এই আসনে বিএনপি যাকেই মনোনয়ন দিক না কেন, তার প্রভাব পড়বে শুধু সুনামগঞ্জ নয়, সিলেট বিভাগের সামগ্রিক রাজনীতিতেও।
জনমতের প্রতিফলন স্থানীয় ব্যবসায়ী ও শিক্ষক মহলের মতে, “কলিম উদ্দিন আহমেদ মিলন অভিজ্ঞ রাজনীতিক; তিনবার এমপি ছিলেন, তাঁর হাত ধরে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। অপরদিকে, তরুণ ভোটারদের মতে, “মিজানুর রহমান মিজান নতুন প্রজন্মের কণ্ঠস্বর। তিনি মাঠে কাজ করেন, ডিজিটাল প্রচারণা বোঝেন, তাই তরুণদের কাছে তিনি বেশি প্রভাবশালী।”
মনোনয়ন এখনও ঘোষণা হয়নি, কিন্তু ছাতক–দোয়ারাবাজারে বিএনপির রাজনীতি ইতোমধ্যেই উষ্ণ। দলের প্রতিটি সভা, কর্মসূচি ও গণসংযোগে মিলন–মিজান দুজনের অনুসারীরা সক্রিয়ভাবে উপস্থিত থাকছেন।
তৃণমূল নেতারা বলছেন, “যে-ই মনোনয়ন পান, দল ঐক্যবদ্ধ থাকলে বিএনপি এই আসনে জয়ের সম্ভাবনা রাখে।”অবশেষে প্রশ্ন একটাই—মিলন না মিজান, কে হবেন ধানের শীষের প্রতীকধারী প্রার্থী?
এই সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবে সুনামগঞ্জ–৫ আসনের রাজনীতির ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা এবং বিএনপির শক্তি পুনর্গঠনের সম্ভাবনা।###
caller_get_posts is deprecated. Use ignore_sticky_posts instead. in /home/eibela12/public_html/wp-includes/functions.php on line 6121caller_get_posts is deprecated. Use ignore_sticky_posts instead. in /home/eibela12/public_html/wp-includes/functions.php on line 6121
Leave a Reply