আধ্যাত্মিক, মানবিক দর্শন ও লোক ক‌বি সাধক হাসন রাজার মৃত্যুবার্ষিকী আজ – এইবেলা
  1. admin@eibela.net : admin :
শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:২৮ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
একদল অপকর্ম করে পালিয়েছে, আরেকদল সেই অপকর্মের দায় কাঁধে তুলে নিয়েছে : শফিকুর রহমান আধ্যাত্মিক, মানবিক দর্শন ও লোক ক‌বি সাধক হাসন রাজার মৃত্যুবার্ষিকী আজ আজ বড়লেখা মুক্ত দিবস : মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের আলোচনা সভা প্রয়াত ডা. পবন চন্দ্র দেবনাথের ছোট ভাই ব্রজেন্দ্র দেবনাথ আর নেই কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথ পুনর্বাসন প্রকল্প পরিদর্শনে রেলওয়ে সচিব- সম্পন্নের ডেডলাইনেও বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় বড়লেখায় খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনায় নফল রোজা শেষে ইফতার ও দোয়া মাহফিল কুলাউড়ায় আদালতের নির্দেশনা ভঙ্গ করে কৃষকদের জমিতে ফসল রোপণের অভিযোগ ছাতকের ইউএনও’কে বিদায় সংবর্ধনা প্রদান ফুলবাড়ীতে বিজিবি’র অভিযানে মাদকদ্রব্য ও ভারতীয় শাড়ি উদ্ধার সহকারি শিক্ষকদের সাটডাউন- বড়লেখায় কক্ষের তালা ভেঙ্গে পরীক্ষা নেওয়ালেন অভিভাবকরা

আধ্যাত্মিক, মানবিক দর্শন ও লোক ক‌বি সাধক হাসন রাজার মৃত্যুবার্ষিকী আজ

  • শনিবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০২৫

Manual1 Ad Code

আনোয়ার হো‌সেন র‌নি

আজ ৬ ডিসেম্বর শনিবার, মরমী সাধক হাসন রাজার ১০৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯২২ সালের ৬ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করা এই প্রথাভাঙা লোকদার্শনিক আজও বেঁচে আছেন তাঁর গানের গভীর মানবিক বার্তায়, তাঁর দর্শনের চিরন্তন আলোয়। জমিদার হয়েও যিনি মানুষের দুঃখ-কষ্টকে নিজের ভেতরের সাধনায় ধারণ করেছিলেন, যিনি গেয়েছেন আত্মচেতনার গান, অন্তরলোকের জাগরণ—তিনি হলেন বাংলার মরমী ঐতিহ্যের অনন্য নাম হাসন রাজা।

বাংলার আধ্যাত্মিক সংগীতের ইতিহাসে তিনি এমন এক শিল্পী, যাঁর জীবন, শিল্প, দার্শনিক চিন্তা এবং সামাজিক অবস্থান নিয়ে এখনো গবেষণা চলছেই। লোকগানের সুরে, বৈষ্ণব-সুফি ধ্যান-দর্শনের সংমিশ্রণে তিনি যে মানবিক ও বিশ্বজনীন বাণী রেখে গেছেন, তা শুধু সিলেটের নয়—বাঙালির আত্মরীতিরও অংশ। এই মৃত্যুবার্ষিকী তাই শুধুই স্মরণ নয়—এটি পুনরাবিষ্কারেরও দিন। তাঁর গান, তাঁর ভাবনা, তাঁর ভূমিকা এবং তাঁর অজস্র ভুলে যাওয়া সৃষ্টিকে নতুনভাবে গবেষণার প্রয়োজনীয়তার দিন।

১. জন্ম-মৃত্যুর পারাবার পেরোনো এই মরমী শিল্পীর মূল পরিচয়—মানুষের কবি লক্ষণশ্রীতে ১৮৫৪ সালের ২১ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন হাছন রাজা। পিতা দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী ছিলেন প্রতাপশালী জমিদার, মাতা হুরমত বিবিও ছিলেন জমিদার পরিবারের মর্যাদাশীল সদস্য। কিন্তু জমিদার পরিবারের ঐশ্বর্যসত্ত্বেও হাসন রাজার জীবনপথ ছিল একেবারে আলাদা।

শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের প্রথমভাগে তিনি ছিলেন বিলাসী জমিদার—শিকার, নাচ-গান, ভোগ-বিলাস, ঘোড়া, নৌকা—সবই ছিল তাঁর জীবনে। কিন্তু ব্যক্তিগত বিপর্যয় ও আত্মশুদ্ধির দীর্ঘ পথ তাঁকে রূপান্তরিত করে। মাত্র ১৫ বছর বয়সে পিতা ও ভাইয়ের মৃত্যু তাঁর জীবনে এক ধাক্কা সৃষ্টি করে। জমিদারি দায়িত্ব এবং অন্তর্দ্বন্দ্ব তাঁকে ধীরে ধীরে নিয়ে যায় এক আধ্যাত্মিক জাগরণের দিকে।

এই রূপান্তরই পরবর্তীতে জন্ম দেয় হাসন রাজা—মরমী শিল্পী, যিনি জমিদার হয়েও ছিলেন সমাজ-মানুষ-দর্শনের এক আলোকিত পথিক। ২. মানবিকতা ও আধ্যাত্মিকতার জগতে তাঁর গান এক অনন্য দলিল হাসন রাজার গান শুধু সংগীত নয়—এ এক দর্শন। তিনি গেয়েছেন জাগতিক প্রেম, আধ্যাত্মিক প্রেম, সমাজ-মানুষের সম্পর্ক, নশ্বরতার বোধ, ব্রহ্ম-সত্তার অনুসন্ধান।

তার গানের কেন্দ্রবিন্দু নশ্বরতা:এই দুনিয়ায় কেউ স্থায়ী নয়”—এই বার্তা তিনি সহজ ভাষায় তুলে ধরেছেন বারবার। তাঁর মূল থিমগুলো—
মানুষ কোথা থেকে আসে,কোথায় যাবে,কেনই বা এসেছে,কীভাবে জীবনের সত্যকে উপলব্ধি করবে
দেহ-আত্মার সম্পর্ক,মানুষের প্রতি মমতা, ভ্রাতৃত্ব, সহনশীলতা এসব গভীর দর্শন তিনি লিখেছেন অসাধারণ সহজ ভাষায়—এটাই তাঁর শৈল্পিক শক্তি।

তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষই সত্যের সন্ধানকারী। ধর্মের গণ্ডি ভেঙে তিনি বলেছিলেন মানুষই মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। তাঁর গান তাই ধর্মীয় বিভেদের বিরুদ্ধে মানবিকতার ঘোষণা। ৩. রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়ন—বাংলার লোকদর্শনের প্রতি গভীর স্বীকৃতি হাসন রাজার প্রতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে মূল্যায়ন পাওয়া যায়, তা বাংলা লোকসংস্কৃতির ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল। কবিগুরু উল্লেখ করেছিলেন—“পূর্ব বঙ্গের একটি গ্রাম্য কবির গানে দর্শনের একটি বড় তত্ত্ব পাই। সেটি এই যে, ব্যক্তি স্বরূপের সহিত সম্পৃক্ত সূত্রেই বিশ্বসত্য।”১৯২৫ সালে দর্শন কংগ্রেসের সভায় এবং লন্ডনের হিবার্ট বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথ এই মন্তব্য করেন।

এ স্বীকৃতি বাংলা আধুনিক সাহিত্যে লোককবির মর্যাদাকে স্থায়ী আসন করে দিয়েছে। ৪. জমিদার হয়েও সমাজ-মানুষের কাছে তিনি ছিলেন‘লোকের কবি’ হাসন রাজা প্রায় ৫ লক্ষ ২৭ হাজার বিঘা জমির মালিক ছিলেন—জাতীয় অধ্যাপক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের গবেষণায় এমন তথ্য পাওয়া যায়। তাঁর জমিদারির আওতাভুক্ত জায়গাগুলো—লক্ষণশ্রী,মহারাম,অচিন্তপুর,লাউড়,
পাগলা,পলাশ,বেতাল,চামতলা,কৌড়িয়া,কুরুয়া
এই বিশাল অঞ্চলজুড়ে তিনি শুধু প্রশাসকই ছিলেন না—অনেক ক্ষেত্রে ছিলেন জনগণের আশ্রয়দাতা। লোকায়ত প্রথার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল গভীর। তাঁর গানের অনুপ্রেরণা তিনি পেয়েছেন মানুষের হাসি-কান্না, কর্মজীবন, আর প্রকৃতির চিরন্তন গতিবিধি থেকে।

Manual1 Ad Code

৫. তাঁর গানের সংগ্রহ ‘হাসন উদাস’লোকসাহিত্যের এক মূল্যবান দলিল ১৯০৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর রচিত গানের সংকলন “হাসন উদাস”—যেখানে ছিল ২০৬টি গান।এছাড়া কিছু গান প্রকাশিত হয়েছিল—হাসন রাজার তিনপুরুষ,আল ইসলাহ্ পত্রিকায় এবং বিভিন্ন সময় অন্যান্য সাময়িকীতে অসংখ্য গান মুখে মুখে ছিল বলে গবেষকদের ধারণা—অনেক গান হারিয়ে গেছে, অনেক গান এখনও সিলেট-সুনামগঞ্জ অঞ্চলে খণ্ডিত রূপে পাওয়া যায়।

লোকঐতিহ্য অনুসন্ধানের গবেষকদের কাছে এই হারিয়ে যাওয়া গানগুলো এখনো গুরুত্বপূর্ণ রিসোর্স।৬. তাঁর শিল্পের বৈশিষ্ট্য—সাধারণ ভাষায় অসাধারণ গভীরতা বাংলার লোকশিল্পে হাসন রাজার মৌলিক অবদান হলো—তিনি দার্শনিকতম সত্যকে বলতে পারতেন গ্রামের মানুষের ভাষায়।
তাঁর গানে ছিল—সহজ বাক্য,গভীর অর্থপূর্ণ রূপক
আত্মজিজ্ঞাসা,জীবনের নশ্বরতার চিহ্ন,মানুষ ও প্রকৃতির নিবিড় সম্পর্ক,আধ্যাত্মিক সত্যের অনুসন্ধান উদাহরণ হিসেবে লক্ষণশ্রী নিয়ে তাঁর বিখ্যাত গান—“কতদিন থাকিবায় লক্ষণ ছিরিরে হাসন রাজা ও রাজাৃএই গান শুধু ভৌগোলিক টান নয়, জীবনের অস্থায়িত্বের দর্শনেরও প্রকাশ।
৭. তাঁর আধ্যাত্মিক যাত্রা—বিলাসী জমিদার থেকে জাগ্রত দার্শনিক গবেষকদের মতে, হাসন রাজার জীবনে এক পর্যায়ে এক তীব্র আধ্যাত্মিক পরিবর্তন আসে।

ধন-সম্পদ, জমিদারি, বিলাস—সবই তিনি উপলব্ধি করে বুঝতে পারেন এগুলো ক্ষণস্থায়ী।এ দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করে তাঁর গান আত্মসমালোচনা,আত্মসমর্পণ,ঈশ্বর ভাবনা, মানুষের মাঝে ঐক্য এই পরিবর্তনই তাঁকে ‘রহস্যাত্মা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয় লোককবির ইতিহাসে। ৮. সুর, সংরক্ষণ ও গবেষণা—সময়ের দাবি,বর্তমানে হাসন রাজার গানকে বিকৃতির অভিযোগ রয়েছে। অসংখ্য আধুনিক উপস্থাপনায়—
শব্দ পরিবর্তন সুরের বিকৃতি ভাষার রূপান্তর
ভুল ব্যাখ্যা এসব দেখা যাচ্ছে। হাসন রাজা গবেষকরা বলছেন—একটি স্ট্যান্ডার্ড নোটেশন, সঠিক সংরক্ষণ ও বিশুদ্ধ সুরে পরিবেশন অপরিহার্য। কারণ—তিনি শুধু বিধৃত গান লেখেননি, তিনি নির্মাণ করেছেন সার্বজনীন দর্শন। তার বিকৃতি মানে বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিকৃতি। ৯. হাসন রাজা মিউজিয়াম—সংরক্ষণে নতুন উদ্যোগের প্রয়োজন সুনামগঞ্জ শহরের তেঘরিয়ায় তাঁর জন্মভিটায় রয়েছে হাসন রাজা মিউজিয়াম। স্থানীয়রা বলছেন, এই মিউজিয়ামকে এখনো একটি পূর্ণাঙ্গ আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা-সংগ্রহশালা হিসেবে গড়ে তোলা হয়নি।
দাবি—আরও গবেষণা নথি সংগ্রহ গান-সুর সংরক্ষণের ডিজিটাল আর্কাইভ ইন্টারঅ্যাকটিভ গ্যালারি গবেষকের জন্য পৃথক রিসোর্স সেন্টার
তাঁর জীবন ও শিল্পের ভিজ্যুয়াল ডকুমেন্টেশন
আন্তর্জাতিক পর্যটনে অন্তর্ভুক্তিকরণ শিল্প-সংস্কৃতিমনস্ক মানুষের মতে, এসব উদ্যোগ নেওয়া গেলে বিশ্বজুড়ে লোকসংগীত গবেষণায় বাংলাদেশের অবস্থান আরও শক্তিশালী হবে।
১০. কেন এখনো গবেষণা জরুরি?—বিশ্লেষণে নতুন দৃষ্টিকোণ

হাসন রাজাকে নিয়ে গবেষণা এখনো অসমাপ্ত। কারণ— তাঁর গান মৌখিক ঐতিহ্যের অংশ
বহু গান হারিয়ে গেছে,অনেক গান বিকৃত
তাঁর দর্শনের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ সীমিত তাঁর জমিদারির ইতিহাসও যথাযথভাবে নথিভুক্ত নয়
সামাজিক রূপান্তরে তাঁর চিন্তার ভূমিকা আরও গবেষণাযোগ্য তাঁর দর্শন বাংলার লোক-আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সুফি, বৈষ্ণব, বাউল ধারাকে নতুনভাবে বোঝার সুযোগ দেয়।

Manual1 Ad Code

১১. হাসন রাজার দর্শন—একজনলোকদার্শনিকের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার আজ তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে গবেষকরা যে প্রশ্ন উত্থাপন করছেন লোকসাধনার এই দর্শন আমাদের আধুনিক সমাজকে কীভাবে আলোকিত করে? হাসন বলেছিলেন—মানুষ জন্মায় সাময়িক সময়ের জন্য মানুষ যখন মানুষের পাশে দাঁড়ায়, তখনই সত্য প্রকাশ পায়

Manual8 Ad Code

শরীর আছে, কিন্তু অন্তরজগৎ আরও বড়মানুষকে জানতে হলে নিজের ভেতরে তাকাতে হবে এই দর্শন আজও সমাজ, রাজনীতি, সহনশীলতা ও মানবিকতার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। এক শতাব্দীরও বেশি সময় পর তাঁর গান নিয়ে নতুন প্রজন্মের আগ্রহ বেড়েছে—এটাই প্রমাণ করে তাঁর শিল্প অসীম জীবনশক্তি বহন করে। হাসন রাজার মৃত্যুবার্ষিকী—নতুন করে তাঁর দর্শনের পুনরাবিষ্কারের দিন ১০৩ বছর পরে আজও তিনি আমাদের কাছে—একজন মানবিক দার্শনিক লোকসংগীতের অমর কবি আধ্যাত্মিক বোধের পথপ্রদর্শক বাংলার সাংস্কৃতিক পরিচয়ের এক উজ্জ্বল প্রতীক তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে মূল প্রশ্ন—

আমরা কি তাঁর গান ও দর্শনকে সংরক্ষণ করতে পেরেছি?নাকি তাঁর অনেক সৃষ্টি বিকৃতি, অবহেলা ও অনাদরে হারিয়ে যাচ্ছে? এই দিনই মনে করিয়ে দেয়—হাসন রাজা কেবল অতীতের একটি নাম নন,তিনি বাঙালির সাংস্কৃতিক আত্মার একটি অপরিহার্য অংশ। তাঁর গানের সহজ ভাষায়—
আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের অস্থায়িত্ব, আমাদের মানবিক দায়িত্ব—সবই প্রতিফলিত। তাই তাঁর গবেষণা, সংরক্ষণ ও আন্তর্জাতিক উপস্থাপনা আজ সময়ের দাবি।

 লেখক : ক‌বি ও সাংবা‌দিক

 

Manual7 Ad Code

সংবাদটি শেয়ার করুন


Deprecated: File Theme without comments.php is deprecated since version 3.0.0 with no alternative available. Please include a comments.php template in your theme. in /home/eibela12/public_html/wp-includes/functions.php on line 6121

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো সংবাদ পড়ুন
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০২২ - ২০২৪
Theme Customized By BreakingNews

Follow for More!