আনোয়ার হোসেন রনি,ছাতক (সুনামগঞ্জ) প্রতিনিধি:
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর জাতির অস্তিত্ব রক্ষার সংকটে যখন পুরো দেশ উত্তাল, তখন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সমবেত হওয়া একদল উদ্যমী তরুণ স্বাধীনতার অমর স্বপ্ন বুকে নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার লক্ষ্যে।
সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার নোয়ারাই ইউনিয়নের বেতুরা এলাকা তাদের সেই যাত্রার শেষ গন্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়ে তারা জীবন্ত মাটিচাপা দিয়ে হত্যা হন—যা আজ ‘শিখা সতেরো’ নামে ইতিহাসের এক অমোচনীয় বেদনাকাব্য।
স্বাধীনতার পর কেটে গেছে ৫৪টি বছর। প্রজন্ম বদলেছে, বদলেছে ছাতকের ভূসংস্থান, মানুষ, সমাজ-সংস্কৃতি; কিন্তু বদলায়নি ‘শিখা সতেরো’র রহস্য। শহীদ ১৭ তরুণের পরিচয় আজও অন্ধকারের অতলে। কেউ জানে না তারা কোন জেলার, কোন গ্রামের সন্তান; কারা অপেক্ষায় ছিল তাদের ফিরে আসার; কার বুক ভেঙেছিল সেই রাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে পতিত হওয়া দামাল ছেলেটির অকাল মৃত্যুতে!
১৯৭১ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বর। মুক্তিযুদ্ধের মোড় ঘুরে যাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত তরুণরা দলে দলে ভারতের সীমান্তবর্তী মুক্তিবাহিনী ট্রেনিং ক্যাম্পে যোগ দিচ্ছেন। ঠিক সেই সময় দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ছুটে আসা ১৮ জন তরুণ সুনামগঞ্জের ছাতকের নোয়ারাই এলাকার সুরমা নদীপথে চেলামুখ সীমান্ত হয়ে ভারতের ত্রিপুরায় ট্রেনিং নিতে রওনা দেন।
কিন্তু দেশমাতৃকার টানে এগিয়ে যাওয়া এই তরুণদের পথরেখায় লুকিয়ে ছিল এক অমানবিক কুয়াশা। নোয়ারাইয়ের বেতুরা অংশে পৌঁছালে খবর পায় স্থানীয় কুখ্যাত রাজাকার ও সাবেক ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মতছির আলী ওরফে ‘ফকির চেয়ারম্যান’। তিনি পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করতেন এবং মুক্তিযোদ্ধা ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ber notorious ছিলেন।
ফকির চেয়ারম্যান তরুণদের কাছে গিয়ে অত্যন্ত কৌশলে বলেন,তোমাদের ভারতীয় সীমান্তে পৌঁছে দিচ্ছি। আগে আমার বাড়িতে একটু বিশ্রাম নাও।”
দেশের জন্য জীবন দিতে বের হওয়া নিষ্পাপ যুবকরা তার কথায় বিশ্বাস করে। তারা জানত না—সেই বাড়িটিই হবে তাদের মৃত্যুর ফাঁদ, যেখানে দেশদ্রোহিতার নোংরা ইতিহাস লেখা হবে।
ফকির চেয়ারম্যান পাকিস্তানি বাহিনীকে খবর পাঠান। কিছুক্ষণের মধ্যেই হানাদার বাহিনীর একটি দল লাফিয়ে পড়ে তার বাড়িতে। মাত্র কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে হাত-পা বেঁধে তরুণদের ছাতক থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। ১৮ জনের মধ্যে ১ জন—ছাতক বাজারের বাসিন্দা জাফর আহমদ কাবেরী—কৌশলে পালাতে সক্ষম হন। বাকি ১৭ জনকে সারা রাত ধরে করা হয় অমানুষিক নির্যাতন।
সেই রাতের বিবরণ ভয়াবহ। প্রত্যক্ষদর্শীরা পরে জানিয়েছেন—রাতভর তাদের আর্তচিৎকার শোনা যেত। লাঠি, বাটন, রাইফেলের বাট—কোনোটিই বাদ যায়নি। পানি পর্যন্ত দেয়া হয়নি। এক রাতের নির্যাতনের পরও মন ভাঙেনি তরুণদের। তারা জানত, তাদের মৃত্যুই স্বাধীনতার ইন্ধন।
কালারুকা ইউপির মাধবপুর পাশে লালপুলে নির্মম হত্যাযজ্ঞ : জীবন্ত মাটিচাপা পরদিন সন্ধ্যায় হানাদার বাহিনী তাদের ছাতক-গোবিন্দগঞ্জ সড়কের লালপুল এলাকায় নিয়ে যায়। সেখানে আগেই স্থানীয় কয়েকজনকে দিয়ে বড় একটি গর্ত খোঁড়ানো হয়। গর্তের পাশে দাঁড়িয়ে তখনো প্রাণ বাঁচানোর আকুতি নিয়ে কাঁপছিল তরুণরা। কেউ কেউ চিৎকার করে বলেছিলেন—“মা…, আমারে বাঁচা…! তাদের সেই কান্না সেদিন আকাশ-বাতাস ভারি করে তুলেছিল। মেশিনগানের গর্জন মুহূর্তেই স্তব্ধ করে দেয় সব। ১৭ তরুণের রক্তে লাল হয়ে ওঠে লালপুলের সবুজ ঘাস। গুলিবিদ্ধ অনেকেই তখনো প্রাণ হারাননি। সেই অবস্থায় হাত-পা বাঁধা শরীরগুলো টেনে-হিঁচড়ে গর্তে ফেলে দেয়া হয়। কয়েকজন তখনো শ্বাস নিচ্ছিলেন—বাঁচার শেষ আকুতিতে মাটি খুঁড়ে উঠতে চাইছিলেন। কিন্তু হানাদাররা তাতে আরো উল্লাস করে গর্তে মাটি চাপা দেয়।
মানুষের ইতিহাসে এমন নির্মমতা কেবল ঘৃণ্য নরপশুদের পক্ষেই সম্ভব। রাতের আঁধারে দাফন—গ্রামবাসীর চোখে জল পরদিন গভীর রাতে গ্রামের কিছু মানুষ সাহস করে সেখানে এসে রক্তাক্ত দেহগুলো মাটি দিয়ে ঢেকে দেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা যে কাজটি করেছিলেন, তা আজ ইতিহাসের অংশ। সেই রাতেই দেশের নাম না জানা ১৭ জন সূর্যসন্তানের জীবন্ত সমাধি রচিত হয় ছাতকের লালপুল এলাকায়। জায়গাটি তখন থেকেই ‘শিখা সতেরো’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।
স্থানীয় প্রবীণদের মুখে শোনা যায়—মাটি চাপা দেওয়ার সময়ও কয়েকজনের শরীর নড়ছিল। কেমন ভয়ানক রাত ছিল! আজও চোখে ভাসে সেই দৃশ্য। স্বাধীনতার পর অনুসন্ধান—অজানা রয়ে যায় শহীদরা ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শুরু হয় অনুসন্ধান। সরকার, স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংগঠন, ইতিহাসবিদ—অনেকেই চেষ্টা করেছেন সেই ১৭ জনের নাম-পরিচয় খুঁজে বের করতে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় ঘোষণা দেওয়া হয়, পত্রপত্রিকায় খবর ছাপা হয়, এমনকি সম্ভাব্য পরিবারগুলোকেও খোঁজা হয়। কিন্তু কোনো সূত্রই কাজ করেনি।
তাদের পরিচয় উদ্ধার না হওয়াই ‘শিখা সতেরো’-র রহস্যকে আরও গভীর করে তুলেছে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি যে এমন ভয়াবহ পরিকল্পনায় মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার স্বপ্নবাজ তরুণদের হত্যা করেছে—তা বহু গবেষকের দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক অন্ধকার অধ্যায়।
স্থানটি সংস্কারের দাবি বহুদিনের স্থানীয়রা বহুবার প্রশাসনের কাছে ‘শিখা সতেরো স্মৃতিসৌধ’টিকে সংস্কার, সংরক্ষণ ও পর্যটন উপযোগী করে তোলার দাবি জানিয়েছেন। এখনো স্থাপনাটি পরিত্যক্ত, অযত্নে পড়ে আছে। এলাকায় অবকাঠামো উন্নয়নের দাবি সত্ত্বেও গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। শিক্ষার্থী, গবেষক ও নতুন প্রজন্মের মানুষ এখানে এলে সহজেই জানতে পারবে স্বাধীনতার বেদনাগাথা ইতিহাস।
মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের মত—“যদি সরকার যথাযথ স্মৃতিসৌধ তৈরি করে, তাহলে দেশজুড়ে মানুষ এই ১৭ অজানা বীরের আত্মত্যাগ থেকে অনুপ্রেরণা পাবে। নতুন প্রজন্ম বুঝবে স্বাধীনতা কীভাবে রক্তে লেখা। অন্ধকারে ডুবে থাকা বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস মতছির আলী ওরফে ফকির চেয়ারম্যান ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর ছিল—এ কথা এলাকায় আজও প্রচলিত। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেকেই বলেন, তিনি দীর্ঘদিন আত্মগোপন করে ছিলেন। সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়নি। ফলে তার অপরাধের পুরো সত্য আজও অজানা। তিনি মৃত্যুবরণ করলেও রেখে গেছেন রক্তে লেখা বিশ্বাসঘাতকতার দাগ।
অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ আজও বলেন—মুক্তিযুদ্ধের খারাপ ইতিহাস বললে ‘শিখা সতেরো’ প্রথম সারিতে থাকবে। নতুন প্রজন্মের কাছে শিখা সতেরো—অপরিচিত এক গৌরবগাথা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যেখানে বহু বীরের নাম জানা আছে, সেখানে এই ১৭ জন অচেনা যুবকের আত্মত্যাগ এক অনন্য ও হৃদয়বিদারক অধ্যায়। তাদের বীরত্ব, সাহস ও দেশপ্রেম নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছানো এখন সময়ের দাবি।
বর্তমানে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীরা ছাতক ভ্রমণে আসলে ‘শিখা সতেরো’ দেখতে চায়। কিন্তু পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে না ওঠায় তাদের হতাশ হয়ে ফিরতে হয়। স্থানীয় শিক্ষকরা বলছেন—এখানে একটি জাদুঘর, ফলক বা স্মৃতিস্তম্ভ হলে ইতিহাস শিখতে আসা শিক্ষার্থীরা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে।”
এলাকাবাসীর দাবি—রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চাই ছাতকের সাধারণ মানুষের দাবি, রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘শিখা সতেরো’কে জাতীয় স্মৃতিসৌধ হিসেবে ঘোষণা করা হোক। অন্তত একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ সৃষ্টি করা হোক। স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপনের সময়ও বিষয়টি আলোচনায় আসে; কিন্তু কোনো উদ্যোগ বাস্তবায়ন হয়নি। স্থানীয়দের কণ্ঠে আক্ষেপ—“যে ১৭ জন নিজেদের পরিচয় রেখে যেতে পারেননি, অন্তত রাষ্ট্র যেন তাদের একটি স্থায়ী ঠিকানা দেয়। ৫৪ বছরের রহস্য—কখনো উদঘাটিত হবে কি? সুনামগঞ্জের ছাতকের মানুষ আজও অপেক্ষা করে আছে—এই ১৭ বীরের পরিচয় খুঁজে পাওয়ার জন্য। গবেষকরা মনে করেন, হয়তো কোনোদিন কোনো দলিল, কোনো ব্যক্তিগত চিঠি, অথবা কোনো পরিবারের স্মৃতির টুকরো থেকে জানা যেতে পারে এই শহীদদের পরিচয়। তাদের নাম-পরিচয় খুঁজে পাওয়া গেলেমুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আরও সমৃদ্ধ হবে, আর স্বাধীনতার ত্যাগের এই অমোঘ গাথা জাতীয় ইতিহাসে স্থান পাবে পূর্ণ মর্যাদায়। শিখা সতেরো’ শুধু ছাতকের নয়; এটি বাংলাদেশের সংগ্রামী ইতিহাসের এক দুঃখগাঁথা। নাম না জানা ১৭ তরুণের তাজা রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি লাল সবুজের পতাকা। তাঁদের পরিচয় আমরা জানি না—তবে তাঁদের আত্মত্যাগ আজও আমাদের স্বাধীনতার শিখা, আমাদের শক্তি, আমাদের চেতনার উৎস।####
caller_get_posts is deprecated. Use ignore_sticky_posts instead. in /home/eibela12/public_html/wp-includes/functions.php on line 6121caller_get_posts is deprecated. Use ignore_sticky_posts instead. in /home/eibela12/public_html/wp-includes/functions.php on line 6121
Leave a Reply