সকাল থেকেই আকাশের মন খারাপ। অঝোর ধারায় বইছে বর্ষণ। ঘর থেকে বের হওয়ার জো নেই। প্রকৃতির এই বিরূপতার মধ্যেও বর্ণিল সাজে সেজেছে নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ফেয়ার মেরিনা। উপলক্ষ নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত ও বহির্বিশ্বে সর্বাধিক প্রচারিত বাংলা সংবাদপত্র ‘ঠিকানা’র জন্মদিন উদযাপন। পত্রিকাটির ৩৪ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে ১৬ জুলাই রোববার দুপুরে সেখানে আয়োজন করা হয় এক পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের। সঙ্গে ছিল পত্রিকাটির বিশিষ্ট লেখকদের সম্মাননা প্রদান। তাইতো ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়ে দুপুর হতেই ওয়ার্ল্ড ফেয়ার মেরিনায় সমবেত হতে থাকেন সুহৃদ, স্বজন ও শুভানুধ্যায়ীরা। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে অতিথিদের উপস্থিতি। একে একে আসতে থাকেন মূলধারার রাজনীতিবিদ, কমিউনিটির বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, কবি-সাহিত্যিক, লেখক-সাংবাদিকসহ প্রবাসের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। একটা সময় সবার প্রাণবন্ত উপস্থিতিতে অনুষ্ঠানস্থল কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। বৃষ্টিঝরা দুপুরে পরিচিতজনদের সঙ্গে আলাপচারিতা ও গল্পে উপভোগ্য সময় কাটান অতিথিরা। সাত শতাধিক আমন্ত্রিত অতিথি অনুষ্ঠানে যোগ দেন। তারা ঠিকানাকে জানান ফুলেল শুভেচ্ছা।
অনুষ্ঠানে আগত অতিথিরা বলেন, প্রবাসীদের আস্থা ও বিশ্বস্ততার আরেক নাম ঠিকানা। পত্রিকাটি ছোট-বড় সকল মহলের পাঠযোগ্য। কেবল সংবাদ প্রকাশের মধ্যেই পত্রিকাটি নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেনি, প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটি বিনির্মাণেও প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। সত্যকে পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ করতে ঠিকানার বিকল্প নেই। প্রবাসে বাংলাদেশের কৃষ্টি-সংস্কৃতি তুলে ধরে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ঠিকানা। বক্তারা আগামী দিনেও ঠিকানার পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। এই মিলনমেলায় বিশিষ্টজনদের সামনে ঠিকানার পক্ষ থেকেও সত্য প্রকাশে অবিচল থাকা এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের কল্যাণে নিরন্তর কাজ করে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়।
অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন জনপ্রিয় ও প্রখ্যাত অভিনেত্রী ও উপস্থাপক শিরিন বকুল এবং জনপ্রিয় উপস্থাপক ও সাংবাদিক আশরাফুল হাসান বুলবুল। ওইদিন দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে শুরু হয়ে অনুষ্ঠান চলে বিকেলে পাঁচটা পর্যন্ত। অনুষ্ঠানের বিভিন্ন পর্বে ছিল উদ্বোধনী পর্ব, উদ্বোধনী নৃত্য, স্বাগত পর্ব। অনুষ্ঠনের শুরুতে ঠিকানার পরিচিতি তুলে ধরা হয়। এর পরই আসে উদ্বোধনী ঘোষণা। বাজানো হয় বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ও আমেরিকার ন্যাশনাল অ্যানথাম। এ সময় উপস্থিত অতিথিরা দাঁড়িয়ে দুই দেশের প্রতি সম্মান জানান। অনেকেই বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের সঙ্গে কণ্ঠ মেলান। এরপর বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের প্রতি এবং বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শহীদদের প্রতি ঠিকানার পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানো হয়। এ সময় সবাই দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন। এর পরই ছিল উদ্বোধনী নৃত্য। এই পর্বে দেশাত্মবোধক নাচ পরিবেশিত হয়। নৃত্য পরিবেশনায় ছিল নীলা জেরিন ডান্স একাডেমি। তারা দেশাত্মবোধকসহ চার ধরনের নাচ পরিবেশন করে। তাদের নৃত্য পরিবেশনা অতিথিদের মুগ্ধ করে।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন ঠিকানার প্রধান সম্পাদক মুহম্মদ ফজলুর রহমান। তিনি তার বক্তৃতায় ঠিকানার শুরু, পথচলা, সাফল্য এবং কমিউনিটি বিনির্মাণে ঠিকানার অবদানের কথা তুলে ধরেন। এরপর বক্তব্য দেন ওয়াশিংটনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রেস মিনিস্টার এজেডএম সাজ্জাদ হোসেন এবং নিউইয়র্কে বাংলাদেশ কনস্যুলেটের ফার্স্ট সেক্রেটারি প্রসূন চক্রবর্তী। তারা ঠিকানার সাফল্য কামনা করেন।
অনুষ্ঠানের মূূল বক্তা ছিলেন ঠিকানার সম্পাদকম-লীর সভাপতি ও সাবেক এমপি এম এম শাহীন। তিনি তার বক্তৃতায় ঠিকানার শুরু, পথচলা এবং ৩৪ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশনা অব্যাহত রাখার সংগ্রামের কথা তুলে ধরেন। ঠিকানা কমিউনিটির জন্য যে অবদান রেখে চলেছে, তাও উল্লেখ করেন। বাংলাদেশের আসন্ন দ্বাদশ নির্বাচনে তিনি অংশগ্রহণ করবেন বলেও উপস্থিত অতিথিদের অবহিত করেন এবং তাদের দোয়া কামনা করেন। আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হলে প্রবাসীদের জন্য কী কী ভূমিকা রাখতে চান, সেটাও উল্লেখ করেন। তিনি সংসদ সদস্য থাকাকালে যেসব কাজ করেছেন, তা তুলে ধরেন। বক্তৃতার একপর্যায়ে আবেগপ্রবণ হয়ে এম এম শাহীন বলেন, রাজনীতি করতে গিয়ে আমি আমার আমেরিকার সম্পদ, ঢাকার সম্পদ এবং কুলাউড়ার সম্পদ বিক্রি করেছি। আমি মানুষের জন্য রাজনীতি করি, নিজের জন্য নয়। তাই আগামী নির্বাচনে প্রবাসীদের তার পাশে থাকার অনুরোধ জানান।
মূল বক্তব্যের পর অনুষ্ঠিত হয় ঠিকানা সম্মাননা পদক প্রদান অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন শিরিন বকুল, তার সঙ্গে ছিলেন আশরাফুল হাসান বুলবুল। সাহিত্য, কবিতা ও ছড়া লিখে ঠিকানার পাতাকে সমৃদ্ধ করায় ঠিকানার পক্ষ থেকে সাতজনকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। সাহিত্যে এবিএম সালেহ উদ্দিন ও রুমিনা লোদী; কবিতায় কাজী অনীক, বেনজীর শিকদার ও রওশন হাসান এবং ছড়ায় মনজুর কাদের ও মামুন জামিল পুরস্কার লাভ করেছেন। সম্মাননাপ্রাপ্তদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন নিউইয়র্কের স্টেট অ্যাসেম্বলি মেম্বার জেনিফার রাজকুমার, নিউইয়র্ক সিটি মেয়র অফিসের ডেপুটি কমিশনার ফর ট্রেড ইনভেস্ট অ্যান্ড ইনোভেশন দিলীপ চৌহান, নিউইয়র্ক সিটি মেয়র অফিস অব অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসেস চিফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার মীর বাসার, সিটি মেয়র অফিসের এথনিক অ্যান্ড কমিউনিটি মিডিয়া এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর মিস্টার হোজে বেওনা এবং ঠিকানা গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এম শাহীন ও প্রধান সম্পাদক মুহম্মদ ফজলুর রহমান। এর আগে পুরস্কারপ্রাপ্তদের জীবনবৃত্তান্ত তুলে ধরা হয়। এরপর একে একে তাদের হাতে ফুলের তোড়া ও ক্রেস্ট তুলে দেওয়া হয়। পুরস্কার প্রদান শেষে তারা তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। সবাই ঠিকানার সাফল্য কামনা করেন এবং ঠিকানার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। এরপর অনুষ্ঠিত হয় পুরস্কারপ্রাপ্তদের সঙ্গে অতিথিদের ফটোসেশন পর্ব। জনপ্রিয় ও দক্ষ চিত্র সাংবাদিক নিহার সিদ্দিকী পুরো অনুষ্ঠানের স্থিরচিত্র ধারণ করেন। পাশাপাশি পুরো অনুষ্ঠানটি তার ফেসবুক থেকে তিনি সরাসরি সম্প্রচার করেন। অনুষ্ঠানে দুই পর্বে খাবার পরিবেশন করা হয়। অতিথিদের বাংলাদেশি সব খাবারের মেন্যু দিয়ে অ্যাপায়ন করানোয় তারা ভীষণ খুশি।
খাবারের পর্ব শেষে ঠিকানার নতুন ওয়েবসাইট thikananews.comএর উদ্বোধন করা হয়। জেনিফার রাজকুমার এর উদ্বোধন করেন। তার সঙ্গে ছিলেন রিয়েল এস্টেট ইনভেস্টর আনোয়ার হোসেন, রিয়েল এস্টেট ইনভেস্টর নুরুল আজিম, জ্যামাইকা ফ্রেন্ডস সোসাইটির উপদেষ্টা এবিএম ওসমান গনি, বাংলাদেশ সোসাইটির এমএ আজিজ প্রমুখ।
এ সময় মঞ্চে ঠিকানা পরিবারের সবাই উপস্থিত ছিলেন। ঠিকানার আগের ওয়েবসাইট ছিল thikana.us। এটি পরিবর্তন করে নতুন নামকরণ করা হয় thikananews.com । এখন থেকে ঠিকানার নতুন ওয়েবসাইটে পাঠক ঠিকানার সর্বশেষ সব খবর পড়তে পারবেন।
এরপর আমেরিকায় বেড়ে ওঠা ও মূলধারায় বিশেষ অবদান রেখে চলেছেন এমন দুজন ব্যক্তিত্বকে পুরস্কৃত করা হয়। ‘বাংলাদেশিস ব্রেকিং বেরিয়ার অ্যাওয়ার্ড’ শিরোনামে যে দুজন নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিকে সম্মাননা জানানো হয় তারা হলেন, নাবিল আলমগীর (সিইও, লাঞ্চ বক্স ডট আইও) এবং জিহান ওয়াজেদ (মূলধারার চিত্রশিল্পী)। তাদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন জেনিফার রাজকুমার। ঠিকানার পক্ষ থেকে রুহিন হোসেন তাদেরকে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টানা হয়। এই পর্বে সংগীত পরিবেশন করেন উদীপ্ত চৌধুরী ও জনপ্রিয় শিল্পী পলি সায়ন্তী। অনুষ্ঠানটি সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ায় ঠিকানার পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান সম্পাদকম-লীর সভাপতি এম এম শাহীন।#
Leave a Reply