নাজমুল হক নাহিদ, আত্রাই (নওগাঁ) প্রতিনিধি :: উত্তর জনপদের মৎস্য ও শষ্য ভান্ডার খ্যাত নওগাঁর আত্রাই উপজেলার গ্রাম-গঞ্জের হাট বাজারে চলছে হালখাতার মহোৎসব। ব্যবসায়ী মহল এখন তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের হালখাতা নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
বড় বড় ব্যবসায়ীতো বটেই প্রতিটি গ্রামের মোড়ে মোড়ে দৈনিন্দন বাজারের দোকানীরাও পাওনা আদায়ে “ হালখাতা” নামক বাংলার এই ঐতিহ্য ধরে রেখেছে।
নওগাঁর অঞ্চলে ফসল ভেদে হাল খাতার উৎসব শুরু হয়। পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হালখাতার মহরৎ হয়ে থাকে। ক্রেতা-বিক্রেতার এটি একটি সেতু বন্ধন ও ঐতিহ্যবাহী দিন। প্রতি বছর বৈশাখকে কেন্দ্র করে চলে হালখাতার মহোৎসব। আর এই দিনটির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে ব্যবসায়ীরা। ধুম ধাম করে আয়োজন করা হয় হালখাতার। পুরাতন বছরের হিসাব-নিকাশ মুছে নব উদ্দীপনায় আগামি বছরের নতুন খাতায় নাম লেখাতে এই হালখাতার আয়োজন। ফলে ষ্টেশনারী দোকান গুলোতে ব্যবসায়ীদের নতুন টালি খাতা কেনার ধুম পড়ে যায়। নওগাঁর আত্রাইয়ে হালখাতা উদযাপনের রেওয়াজ শত বছর ধরে। তবে হালখাতা একসময় শহরের অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পালন করা হলেও এখন এই রেওয়াজে কিছুটা ফাটল ধরেছে। তবে উপজেলা সদর বাজার এবং ছোট ছোট হাট গুলোতে এখনো রমরমা অবস্থায় হালখাতা অনুষ্ঠিত হয়। হালখাতা অনুষ্ঠানে পুরানো বছরের লেনদেন পরিশোধ করে নতুন খাতায় নাম লেখায় ব্যবসায়ীরা। আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া পালন করা হয়। এজন্য ক্রেতাদের আগের বছরের সকল পাওনার পরিশোধ করার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। এউপলক্ষে হালখাতার দিন তাদের মিষ্টি মুখ করানো হয় ক্রেতাদের(খরিদ্দার) আগে একটি খাতায় ব্যবসায়িরা তাদের যাবতীয় হিসাব লিখে রাখতেন। হালখাতায় বিক্রেতা নতুন করে ক্রেতার হিসেব- নিকেশ হাল নাগাদ করা হয়। হিসেবের খাতা হালনাগাদ করার এ রীতি থেকেই উদ্ভব হয় হালখাতার। একসময় বাংলা নব-বর্ষের মূল উৎসব ছিলো হালখাতা। এ উপলক্ষে দোকানে দোকানে মিষ্টি বিতরন করা হতো। অনেকে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে মিষ্টান্ন পাঠাতেন। হালখাতার হাল আগের মতো না থাকলেও চিরায়ত এই অনুষ্ঠানটি কিন্তু হারিয়ে যায়নি এখনও্।
হালখাতা উপলক্ষে অনেকে বাহারি কার্ডের ব্যবস্থা করেন। কেউবা মুখে মুখেই সারেন দাওয়াত পর্ব। রশগোল্লা, জিলাপী, পুরি মিষ্টি ক্রেতাদের দেয়া হয়। আবার অনেকে কোমল পানীয় থেকে শুরু করে বিরিয়ানি কিংবা তেহারির ব্যবস্থাও করে থাকে হালখাতায়। প্রতিবছর হালখাতার দিন এলে ব্যবসায়ীরা নতুন টালি খাতা কিনে আবার নতুন করে হিসাব-নিকাশ শুরু করে। পাশাপাশি বছরের এই দিন যেন ক্রেতা ও বিক্রেতার মিলন মেলা। যে কোন কারণে ব্যবসায়ীরা ক্রেতাদের কাংক্ষিত উপস্থিতি এবং দেনা-পাওনা পরিশোধ না করলে ঘটে যায় অঘটন। এমনকি সংঘর্ষও ঘটে। তবে যাই হোক ব্যবসায়ীরা মনে করছে ব্যবসার প্রসারে হালখাতার গুরুত্ব অনেক। ব্যবসায়ীরা মনে করেন বাংলা নতুন বছরের হালখাতা হল ব্যবসায়ীদের সম্পর্কের সৌহার্দ্য ও ভালোবাসার প্রতীক। হালখাতাকে কেন্দ্র করে ব্যবসায়ীদের মধ্য তৈরী হয় মিলনমেলা। বৈশাখ যেমন সকল ধর্মের সার্বজনীন উৎসব তেমনি হালখাতাও সকল ব্যবসায়ীদের সার্বজনীন উৎসব।
সরোজমিন উপজেলার সাহেবগঞ্জ বাজার, আত্রাই নতুন বাজার, কাশিয়াবাড়ী স্লুইজগেট বাজার, নওদুলীবাজার, পতিসর বাজার, মির্জাপুর-ভবানীপুর বাজার, সাহাগোলা ষ্টেশন বাজার, বজ্রপুর বাজার, সমসপাড়া হাট, আহসানগঞ্জ হাট, আত্রাই ষ্টেশন বাজার, বান্দাইখাড়া বাজারসহ দেখা যায় প্রায় ৩৫টি দোকানে হালখাতার মহরৎ অনুষ্ঠিত হয়েছে। হালখাতার আয়োজনে ঘরগুলোকে নানা আঙ্গিকে সাজানো হয়েছে।
উপজেলার ভবানীপুর-মির্জাপুর বাজারের বিভিন্ন দোকানে আলোকসজ্জাও করা হয়। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যবসায়িক হিসাবে-নিকেশ। জানাযায়, বাংলা নতুন বছরের হালখাতার মাধ্যমে শত বছরের ঐতিহ্যকে রক্ষা ও ব্যবসায়ীদের মাঝে ভ্রাতৃত্বের সৃষ্টি করে। এখন হালখাতার প্রচলন অনেকটা কমে গেছে। তারপরও আমরা এই প্রথা ধরে রাখার জন্য চেষ্টা করছি।
ভবানীপুর হাট এন্ড বাজারের বণিক সমিতির সভাপতি আব্দুল গফুর খাঁ বলেন, হালখাতার মধ্যমে ব্যবসায়ীরা তাদের আগামি বছরের সম্পর্ককে আরও বেশি দৃঢ় করতে এবং ব্যবসার প্রসার ঘটাতে এ আয়োজন সব সময় ধরে রাখবে বলে আমি আশা করছি। তিনি আরো বলেন হালখাতাকে কেন্দ্র করে আনেক আতœীয় স্বজন ও শুভাকাংঙ্খিরাও বাড়িতে আসে। পুরো বাড়িসহ পরিবেশ যেন উৎসবমুখর হয়ে উঠে। #
Leave a Reply