নিজস্ব প্রতিবেদক :: একসময়ে পাখির নিরাপদ আবাসস্থল বলা হতো দক্ষিন এশিয়ার সর্ববৃহৎ হাকালুকি হাওরকে। ছিলো মাছ ও পাখির অভয়াশ্রম। কিন্তু গত কয়েক বছরে তা বিলীন হয়ে গেছে। হাওরে আসা অতিথি পাখিরা মরছে বিষটোপ আর শিকারিদের পাতানো ফাঁদে।
হাকালুকি হাওড় অবস্থিত দেশের উত্তর-পূর্বঞ্চলের মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলার ৫টি উপজেলা নিয়ে। ১৮১ দশমিক ১৫ বর্গকিলোমিটার জলাভূমি এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই হাওরে ছোট বড় ২৪৩ বিল। সরকার ১৯৯৯ সালে হাকালুকি হাওড়কে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন (ইসিএ) এলাকা ঘোষণা করে। ২০০০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত পরিবেশ অধিদপ্তর বিভিন্ন প্রকল্প পরিচালনা করে ফিরিয়ে আনে হাওরের পরিবেশগত ভারসাম্য। ১২টি মৎস্য অভয়াশ্রম গড়ে তোলা হয়। যেগুলো মাছ ছাড়াও অতিথি পাখির অবাধ বিচরণ ছিলো।
বুধবার মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার হাকালুকি হাওড়ের জুড়ীর অংশে নাগুয়া ও চাতলার বিলে সরেজমিনে গেলে নাগুয়া বিলের পাশে বিষটোপে মরা ৩২ টি হাঁস প্রজাতির পরিযায়ী পাখি নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। আশেপাশে একটি দুটি করে ধুকে ধুকে মরছে আরও কয়েকটি পাখি। এগুলো বাংলাদেশের পরিযায়ী পাখি পিয়াং হাঁস ও উত্তুরে ল্যাঞ্জা হাঁস।
স্থানীয় লোকজন বলেন, শিকারি তারা দল বেধে বিষটোপ ও জাল দিয়ে ফাঁদ পেতে পরিযায়ী পাখি শিকার করছে। তারা সেসব পাখি গোপনে চড়া দামে বিক্রিও করছে। চাতলা বিলের ইজারাদার হাবিবুর রহমান জানান, হাকালুকি হাওড়ে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার পাখির সংখ্যা তুলনামূলক অনেক কম।
আগে আগে অনেক পাখি দেখতাম এবার এসব চোখে পড়ছে না। পরিচয় গোপন রেখে বড়লেখা উপজেলার আজিমগঞ্জ বাজারের একজন ব্যবসায়ী জানান, প্রতিদিন ৭ থেকে ৮ জনের একটি পাখি শিকারি দল নিয়মিত শিকার করে। বাজারে পাইকারি দরে পাখি বিক্রি করে। পরে এগুলো স্থানীয় বাজার ও বসতবাড়িতে বিক্রি করা হয়।
হাওড়ে পাখি কিনতে পাওয়া যায় কিনা জানতে চাইলে স্থানীয় একজন বলেন, হাকালুকি হাওড়ের পাখির অনেক দাম ২টা হাঁস পাখি ১৬০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। অনেকে অগ্রিম অর্ডার দিয়ে রাখেন। আপনার লাগলে অর্ডার দিতে পারেন। এখানে অনেকেই শিকার করে। তবে শর্ত হলো কেনার সময় একা আসতে হবে।
পাথারিয়া বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ টিমের সদস্য খালিদুর রহমান জানান, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন-২০১২ অনুযায়ী যে কোনো বন্যপ্রাণী হত্যা, শিকার, ক্রয়-বিক্রয় ও নিজের দখল বন্ধি করে রাখা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু শীত মৌসুমে একটি কুচক্রী মহল পাখি শিকারের মতো নিকৃষ্ট একটি কাজে লিপ্ত। আমরা মানুষকে সচেতন করে যাচ্ছি, তবুও এসব বন্ধ করতে পারছি না।
তিনি আরও বলেন, হাকালুকি হাওর বাংলাদেশের বেশিরভাগ দেশী প্রজাতির পাখির আবাসস্থল ছাড়াও পরিযায়ী পাখির অবাধ বিচরণভূমি হিসেবে পরিচিত ছিলো। দেশে যে কয়টি জলাভূমিতে অতিথি পাখির আগমন ঘটতো হাকালুকি ছিলো তাদের অন্যতম। আইন আছে কিন্তু আইনের প্রযোগ না থাকায় এখন পাখির নিরাপদ আবাসস্থল শিকারীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় হাকালুকি হাওরের প্রতি নজর দিতে
হবে নতুবা সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।
পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের এসোসিয়েট প্রফেসর, এপিডেমিওলজি ও সৌখিন বন্যপ্রাণী চিত্রগ্রাহক ডাঃ মোঃ রিজওয়ানুল করিম জানান, হাকালুকি হাওড়ে পাখি দেখতে এবং ছবি তোলার জন্য আমরা ৪ জন সম্প্রতি গিয়েছিলাম নাগুয়া ও চাতলার বিলে। তখন আমরা নিজের চোখে এই নিষ্টুর বিষয়গুলো দেখে হতভম্ব হয়ে যাই। মানুষ মাছ ধরার নামে রাত্রে বিভিন্ন ধরনের জাল ও বিষটোপ প্রয়োগ করে আর ভোরবেলা এসে বিষটোপ খেয়ে মরা এই পাখি গুলো ধরে জবাই করে বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করে থাকে। এসব পাখি খেয়ে মানুষ বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, এই বিষক্রিয়ায় মৃত পাখিগুলো জবাই করে বিভিন্ন হোটেলগুলোতে পাখির মাংস হিসাবে বিক্রয় করা হয়। ফলে একদিকে জীববৈচিত্র্যের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে অন্যদিকে এইসব বিষযুক্ত পাখির মাংস খেয়ে সাধারণ মানুষ স্নায়ু, কিডনী, লিভারের জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারে এমনকি ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনাও যথেষ্ঠ। বয়োবৃদ্ধ মানুষ, গর্ভবতী নারী ও শিশুদের বেলায় এই ঝুকি অনেকগুণ বেশী। এই পাখির মাংস খাওয়া থেকে নিবৃত্ত করার জন্য সকল শ্রেণী পেশার মানুষকে এখনই সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি পরিযায়ী পাখি রক্ষায় বন বিভাগ সহ সংশ্লিষ্ট সকলের নিয়মিত প্রশাসনিক মনিটরিং এবং আন্তরিক সহযোগিতা থাকতে হবে।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জানান, বিষটোপ দিয়ে পাখি হত্যার বিষয়টি আমি জেলা প্রসাশকের কার্যালয়ে আইন শৃঙ্খলা মিটিংয়ে কথা বলেছি। ঘটনার সাথে জড়িতদের অনুসন্ধান করে খুব দ্রুত আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করছি।#
Leave a Reply